২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৯:৩৩ অপরাহ্ন
সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে বঙ্গবন্ধু টানেল
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৮-২০২৩
সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে বঙ্গবন্ধু টানেল

দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ও দীর্ঘতম টানেল চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। ‘ওয়ান সিটি, টু টাউন’ মডেলের স্বপ্নের টানেলটি এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। উন্নয়নের মাইলফলক এই টানেল চালু হলে সম্ভাবনার একটি নতুন দুয়ার উন্মোচিত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই টানেল চালুর জন্য যাবতীয় কার্যক্রম শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। চলছে উদ্বোধনী প্রস্তুতি। আগামী মাসেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেলটি উদ্বোধন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করবে টানেল যুগে।

পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের পর এবার বাঙালির আরেক গর্বের মেগা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলটি চালু হলে বিশ্বে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরো বেড়ে যাবে। দেশের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে সূচিত হবে আরেকটি মাইলফলক। সাশ্রয় হবে কর্মঘণ্টা, কাজে আসবে গতিশীলতা। মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হবে, বাড়বে জাতীয় প্রবৃদ্ধি। এই টানেল চালু হলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চল দেশের সর্ববৃহৎ শিল্পাঞ্চলে রূপ নেবে বলে আশা অর্থনীতিবিদ ও উদ্যোক্তাদের।

বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, টানেল চালু হওয়ার জন্য যা যা করণীয়, তার শতভাগ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। এখন শুধু চূড়ান্ত পর্যায়ের ইলেকট্রিক্যাল ও ব্যবস্থাপনার কাজ চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী সেপ্টেম্বরে টানেলটি উদ্বোধন করবেন বলে আশা করা


হচ্ছে। তিনি জানান, শ্রমিক ও প্রকৌশলীরা বহুল প্রতীক্ষিত টানেলটি সেপ্টেম্বরে উদ্বোধনের জন্য দিনরাত কাজ করছেন। টানেল প্রকল্পের ৯৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি দুই শতাংশ কাজ শিগগিরই শেষ হবে। টানেলে বড় আর কোনো কাজ নেই উল্লেখ করে প্রকল্প পরিচালক বলেন, দুটি টিউবই প্রস্তুত রয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি মাসের মধ্যেই কাজ শেষ হওয়ার পর উদ্বোধনের তারিখ জানিয়ে দেবে মন্ত্রণালয়।

প্রকল্পের বিবরণ অনুসারে, টানেলটি আসলে চট্টগ্রামকে ‘ওয়ান সিটি উইথ টু টাউনস’- এ পরিণত করবে। এটি কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত হচ্ছে এবং চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে এটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে। মাল্টিলেন টানেলটি সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরকে আনোয়ারা উপজেলার সঙ্গে সংযুক্ত করবে, যা সরাসরি কক্সবাজারকে চট্টগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। প্রকল্পের বিবরণে বলা হয়েছে, ১১ মিটার ব্যবধানে দুটি টিউব নির্মাণ করা হয়েছে, যাতে ভারী যানবাহন সহজে টানেলের মধ্য দিয়ে যেতে পারে। টানেলের দৈর্ঘ্য হবে ৩ দশমিক ৪০ কিলোমিটার। ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটারের একটি অ্যাপ্রোচ রোডসহ ৭৪০ মিটার একটি সেতু মূল বন্দর নগরী এবং নদীর পশ্চিম প্রান্তকে সংযুক্ত করেছে। প্রকল্পের অংশ হিসেবে প্রধান বন্দরনগরী ও কর্ণফুলী নদীর পশ্চিম পাশকে নদীর পূর্ব দিকে এবং আনোয়ারা উপজেলার সঙ্গে যুক্ত করে মোট ৭৪০ মিটার দৈর্ঘ্যরে সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে ১৮ থেকে ৩৬ মিটার গভীরতায় সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। নদীর মাঝ পয়েন্টে এই গভীরতা প্রায় ১৫০ ফুট। প্রতিটি ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার। চট্টগ্রামে পতেঙ্গার নেভাল একাডেমি প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে নদীর তলদেশ হয়ে টানেলটি চলে গেছে আনোয়ারার চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মাঝামাঝি স্থানে।

যোগাযোগব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন : উন্নয়নের মাইলফলক এই টানেল চালু হলে সম্ভাবনার একটি নতুন দুয়ার উন্মোচিত হবে। টানেলকে ঘিরে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামনগরীর এবং পর্যটননগরী কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এই টানেল চালু হলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চল দেশের সর্ববৃহৎ শিল্পাঞ্চলে রূপ নেবে বলে আশা অর্থনীতিবিদ ও উদ্যোক্তাদের। ইতোমধ্যে আনোয়ারা উপজেলা প্রান্তে সংযোগ সড়কের দুপাশে গড়ে উঠছে ছোটবড় অসংখ্য শিল্প-কারখানা। টানেলকে ঘিরে পর্যটন, শিল্পায়নসহ অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা। চট্টগ্রাম উন্নয়ন বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, কর্ণফুলী টানেল শুধু দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলবে, তেমনটা নয়। এর মাধ্যমে দক্ষিণ চট্টগ্রামের শিল্প-কারখানাসহ অর্থনৈতিক বিপ্লব হবে। এছাড়া পর্যটনশিল্পের জন্য বয়ে আনবে নতুন মাত্রা। বঙ্গবন্ধু টানেল চালু হলে চট্টগ্রাম প্রকৃত অর্থেই বাণিজ্যিক রাজধানী হয়ে উঠবে। এই টানেল একদিকে যেমন বাংলাদেশের মর্যাদাকে তুলে ধরবে; পাশাপাশি অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী করবে। টানেল ঘিরে বৃহত্তম চট্টগ্রাম হবে একটি সমন্বিত বিজনেস হাব। সৃষ্টি হবে বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থান। বাড়বে বৈদেশিক বাণিজ্য। ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের নবনির্বাচিত সভাপতি এবং চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলম জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু টানেল অর্থনীতি, যোগাযোগ এবং পর্যটন খাতে ব্যাপক অবদান রাখবে। বিশেষ করে এটি হবে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এগিয়ে নেয়ার রোডম্যাপ। টানেলটি চালু হলে এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জন্য একটি গেম চেঞ্জার হবে, যা দেশের বাকি অংশের সঙ্গে যোগাযোগের সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তিনি বলেন, টানেলের আশপাশের এলাকায় নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন, বাণিজ্যিক ব্যাংকের নতুন শাখা খোলাসহ ব্যাপক বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে। চট্টগ্রাম-ঢাকা এবং কক্সবাজারের মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে টানেল।

২০০৮ সালে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানের জনসভায় প্রধানমন্ত্রীর কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রæতি দেন। এরপর ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরপরই শুরু হয়েছিল নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের সম্ভাব্য সমীক্ষাসহ সবধরনের কর্মকাণ্ড। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে চায়না কমিউনিকেশনস ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম টানেল টিউবের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টানেলটি প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়েকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করবে এবং দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে। এই টানেলে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে যানবাহন চলবে। ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু টানেল। বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ অর্থায়নে টানেল প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। চীনের এক্সিম ব্যাংক দুই শতাংশ সুদে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে এবং বাকি অংশের অর্থায়ন করছে বাংলাদেশ সরকার। গত ২৬ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দক্ষিণ প্রান্তের একটি টিউবের পূর্ত কাজের সমাপ্তি উদযাপন করা হয়। এই উদযাপন অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়লি যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে ৭০০ মিটারের একটি উড়াল সড়ক বা ফ্লাইওভারসহ পাঁচ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে চারলেন সড়ক নির্মিত হয়েছে, যা আনোয়ারা চাতরি চৌমুহনীতে এসে চট্টগ্রাম আনোয়ারা বাঁশখালী পিএবি সড়কের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। অপরপ্রান্তে দশমিক ৫৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক মিলিত হয়েছে নগরীর পতেঙ্গা নেভাল একাডেমি পয়েন্ট দিয়ে বিমানবন্দর সড়ক, সৈকত সড়ক, চট্টগ্রাম আউটার রিং রোড, লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল সড়কের সঙ্গে। চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও নগরীর পতেঙ্গা প্রান্তে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে ৩৮৩ একর।

টানেলের জন্য সেতু কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবিত টোল হার গত ২০ ডিসেম্বর অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রণালয়। এতে সর্বনি¤œ ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা পর্যন্ত টোল আদায়ের প্রস্তাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। টানেলে দ্বি-চক্র, তিন চাকার যান, গ্যাস সিলিন্ডারসহ বিপজ্জনক দাহ্য পদার্থ বহনকারী গাড়ি ও পায়ে হেঁটে কোনো মানুষ পারাপার হতে পারবে না। সেতু কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, প্রাইভেটকার, জিপ গাড়ি ও পিকআপকে ২০০ টাকা, মাইক্রোবাসকে ২৫০, ৩১ কিংবা এর চেয়ে কম আসনের বাসকে ৩০০, বত্রিশ কিংবা তার চেয়ে বেশি আসনের বাসকে ৪০০ টাকা টোল দিতে হবে। পাশাপাশি পাঁচ টনের ট্রাককে ৪০০, পাঁচ থেকে আট টনের ট্রাককে ৫০০, আট থেকে ১১ টনের ট্রাককে ৬০০ টাকা টোল দিতে হবে।


শেয়ার করুন