নিজেদের অভ্যন্তরীণ বাজার ঠিক রাখার কথা বলে প্রতিবেশী দেশ ভারত পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। শনিবার এ ঘোষণা দেয় দেশটি। এর পরদিন রোববার সেখানে সাপ্তাহিক ছুটির কারণে বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ফলে সোমবারের আগে নতুন শুল্ক পরিশোধ করে পেঁয়াজে আমদানির সুযোগ ছিল না; কিন্তু সেই পেঁয়াজ আসার আগেই বাংলাদেশের বাজারে বাড়তি দামে বিক্রি করছেন ব্যসায়ীরা। গত দুই দিনে বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে গড়ে সাড়ে ১২ টাকা। দৈনিক চাহিদার হিসাবে এই সময়ে সাধারণ মানুষকে বাড়তি ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় ১৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা।
জানা গেছে, নতুন দামের পেঁয়াজ না এলেও স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীরা ভারতীয় পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১৫ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন। দাম আরও বাড়বে বলে তারা প্রচার করছেন।
সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের আমদানিকারক ফিরোজ বিশ্বাস জানান, ভারতে সাপ্তাহিক বন্ধ থাকায় রোববার এলসি করা যায়নি। আজ (গতকাল) ব্যবসায়ীরা এলসি করার বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছেন। এখন যেসব পেঁয়াজ আসার অপেক্ষায় আছে সেগুলো আগের এলসি করা।
গতকাল ঢাকার পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭৮ থেকে ৮০ টাকায়। আমদানি করা পেঁয়াজের কেজি ছিল ৬৭ থেকে ৭০ টাকা। শুল্ক আরোপের দিন অর্থাৎ, গত শনিবার দেশি পেঁয়াজ ছিল সর্বোচ্চ ৭০ টাকা। আমদানি করা পেঁয়াজ ছিল ৬০ থেকে ৬৩ টাকা।
ঢাকার শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়ত বণিক সমিতির সভাপতি হাজী মো. সাঈদ বলেন, নতুন দামের কোনো পেঁয়াজ দেশের বাজারে আসেনি। এই পেঁয়াজ আসতে অন্তত এক সপ্তাহ লাগতে পারে। তবে বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও কেজিতে ১০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। রবি ও সোমবার আমদানি করা পেঁয়াজের (পাইকারি) কেজি বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৬২ টাকায়।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ হামিদুল্লা মার্কেট ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. ইদ্রিস বলেন, বেশি দামের মাল এখনো দেশে আসেনি। আগের আমদানি মাল বিক্রি করছি। বাজার গতকাল (রোববার) থেকে আজ (গতকাল) কমেছে। দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতা উপস্থিতি কম। তবে দাম যা বাড়ার বেড়ে গেছে। এখন বেশি দামের পেঁয়াজ এলেও পাইকারিতে প্রভাব পড়বে না। আমদানি পেঁয়াজের কেজি এখনকার মতো ৬০ থেকে ৬৫ টাকার মধ্যে থাকবে বলে আশা করছি।
অন্যদিকে শুল্ক আরোপের খবর আসার আগে খুচরা পর্যায়ে দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা, যা রোববার বেড়ে দাঁড়ায় ৯০ টাকা। আর গতকাল সোমবার এই পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৯৫ টাকায়। কোথাও কোথাও ১০০ টাকা। এখানে বেড়েছে ১০ টাকা। আর আমদানি করা পেঁয়াজের দাম এ সময় ৬০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৫ টাকা। গত দুদিনে দাম বেড়েছে ১৫ টাকা।
নতুন শুল্কে আমদানি করা পেঁয়াজ এখনো দেশে না এলেও দাম বাড়ার প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘আমাদের ব্যবসায়ীরা সব সময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। এখনো তাই হচ্ছে। নতুন শুল্কের পেঁয়াজ দেশে আসতে আরও ৭ থেকে ১০ দিন লাগবে; কিন্তু এর মধ্যে তারা দাম বাড়িয়ে ভোক্তার কাছ থেকে অবৈধভাবে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তবে নিজস্ব সংরক্ষণ ব্যবস্থা মজবুত থাকলে প্রতিবছর এসব ব্যবসায়ী এভাবে সংকট তৈরি করতে পারত না। সেজন্য উৎপাদন-পরবর্তী সংরক্ষণে জোর দেওয়া গেলে বা যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে অন্তত পেঁয়াজের বাজারে কারসাজি থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ৩৫ লাখ টনের বেশি। এর মধ্যে উৎপাদনের পর প্রক্রিয়াজাত, পরিবহন ও সংরক্ষণ ২৫ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। এ বছর ঘাটতি মেটাতে গত ৫ জুন থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে গত শনিবার পর্যন্ত ৩ লাখ ৬০ হাজার টনের মতো পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। এ ছাড়া নতুন শুল্ক আরোপের আগে খোলা ঋণপত্রের (এলসি) অনেক পেঁয়াজ এখন দেশে আসছে।
জানা গেছে, বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৭ থেকে ২৮ লাখ টন। এর মধ্যে ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে শুধু রোজার মাসের চাহিদা সাড়ে তিন থেকে ৪ লাখ টন। ফলে রোজার মাস ছাড়া বাকি ১১ মাসে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টন। এর প্রতি মাসে চাহিদা ২ লাখ ১৮ হাজার ১৮১ টন। প্রতি দিনের চাহিদা ৭ হাজার ২৭২ টন। প্রতি টনে ১ হাজার কেজি হিসাবে ২ দিনে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪৪ হাজার কেজি পেঁয়াজ বাজার থেকে সাধারণ ভোক্তারা ক্রয় করেছেন। প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম গড়ে সাড়ে ১২ টাকা বেড়ে যাওয়ায় সব মিলিয়ে ক্রেতাদের বাড়তি খরচ করতে হয়েছে ১৮ কোটি ১৮ লাখ টাকার মতো।
এদিকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘আমরা ভোক্তার স্বার্থে বাজার তদারকি করি। এর মানে শুধু আমরাই বাজার সহনীয় রাখতে কাজ করব! বিষয়টি এমন নয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও তাদের লোকবল আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। সবাই মিলে বাজার তদারকি করলে অসাধু ব্যবসায়ীরা এমন করার সুযোগ কম। তার পরও আমাদের যে লোকবল আছে, তা নিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (বাজার সংযোগ-১) প্রণব কুমার সাহা বলেন, আমদানির অনুমতির পর (৫ জুন) ভারত থেকে পেঁয়াজ আসা শুরুর কিছুদিনের মধ্যে সেখানে বন্যা দেখা দেয়। এতে যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আমদানি ও সরবরাহ সমস্যা দেখা দেয়। এতে বাজার বাড়তে শুরু করে। এখন ভারত তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে শুল্ক আরোপের পর দাম আরেক দফা বাড়ছে। তবে নতুন দামের পণ্য আসতে সময় লাগবে। এর মধ্যে যেসব ব্যবসায়ী আগের কম দামের পণ্য বেশি দামে বিক্রি করছেন, তাদের পর্যবেক্ষণে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সারা দেশে তদারকি জোরদার করা হয়েছে। বাজার পরিস্থিতি অস্থিতিশীলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।