২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৬:২৩:১০ অপরাহ্ন
উন্নয়নের সবক্ষেত্রেই এগিয়েছে ঠাকুরগাঁও
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-০৮-২০২৩
উন্নয়নের সবক্ষেত্রেই এগিয়েছে ঠাকুরগাঁও

৭টি নদনদী ঘেরা সবুজ-শ্যামল হিমালয়ের কোলঘেঁষা উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁও। জেলাটির আয়তন ১ হাজার ৮১০ বর্গকিলোমিটার। হিরন্ময় ঐতিহ্যের এই জনপদে রয়েছে সমৃদ্ধ, লোকসংস্কৃতি, দর্শনীয় স্থান, পুরাকীর্তি আর হাজার বছরের ইতিহাস। ঊর্বর ভূমিতে বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদন, দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা, বয়স্ক-বিধবা-প্রতিবন্ধি ভাতাসহ নতুন নতুন উদ্যোগে গত দেড় দশকে বদলে গেছে এই জেলার মানুষের জীবনচিত্র। এছাড়া বিদ্যুৎ, শিক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে পরিবর্তন এসেছে সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়। শতভাগ বিদ্যুতায়ন, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনে অগ্রসর হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা। যাকে ঘিরে আগামীতেও রয়েছে অপার সম্ভাবনা।

সর্ব উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁও একসময় ছিল অবহেলিত। বর্তমানে বদলে গেছে বহুমাত্রিক উন্নয়নে। শহরের সুবিধা পৌঁছে গেছে গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায়। একসময় লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ ছিল জেলার মানুষ। বর্তমানে শতভাগ বিদ্যুতে আলোকিত প্রতিটি ঘর। এখান থেকে উৎপাদিত ১০৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এখন যুক্ত হচ্ছে জাতীয় গ্রিডেও। যে জেলার সমাজ ব্যবস্থায় এক সময় ছিল ঘোর অন্ধকার। জঙ্গিবাদের থাবায় কেঁপেছিল এ জনপদ। এখন সেই দিন আর নেই। উগ্রতা ও ধার্মান্ধতার বালাই নেই। জঙ্গিবাদী কার্যক্রমকে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা ও জঙ্গিদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে সাফল্য দেখিয়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের প্রশাসন। জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে চোখে পড়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্য সেবা।

ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, জেলায় প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। এই জেলার উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডেও যুক্ত হচ্ছে। এখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ায় গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সেবা ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে। প্রতিটি ঘরে, কল-কারখানায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ সব জায়গায় বিদ্যুৎ আছে। জেলার চাহিদার তুলনায় আমরা বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছি। ফলে ঠাকুরগাঁওয়ে এখন শিল্পায়নের কাজ চলছে।

বিদ্যুৎ পাচ্ছে শতভাগ মানুষ : ২০২২ সালে ঠাকুরগাঁও জেলায় ১১৫ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়। বর্তমান সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্র, জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ থেকে নেসকো ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মাধ্যমে ইতোমধ্যে জেলার শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎসেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। ২০০৫-৬ সালে ঠাকুরগাঁও জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩০ মেগাওয়াট। এখন বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিমাণ ১০৪ মেগাওয়াট। ওই সময় মাত্র ৬০ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় ছিল। আর এখন শতভাগ।

ঠাকুরগাঁও বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক (অপারেশন) জাহিদুল ইসলাম জানান, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা ১৩২ মেগাওয়াটের। পিক আওয়ারে ১১৪ মেগাওয়াট চাহিদা থাকে। তবে চুক্তি অনুযায়ী ১১৫ মেগাওয়াট উৎপাদন করা হয়। যা পুরো ঠাকুরগাঁওয়ের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাচ্ছে।

শিক্ষায় প্রযুক্তির ছোঁয়া : জেলার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। শিক্ষার মান উন্নয়নে নেয়া হয়েছে অনেক নতুন নতুন পদক্ষেপ। এর মধ্যে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন, শতভাগ উপবৃত্তি কার্যক্রম, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন, ডিজিটাল স্মার্ট ক্লাসরুম স্থাপন, শিক্ষার্থীদের মাঝে ল্যাপটপ বিতরণ, বিদ্যালয়ে ওয়াইফাই সংযোগ স্থাপন প্রভৃতি। সরজমিনে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ফলে শিক্ষার্থীরা সহজে মালটিমিডিয়া ক্লাস ব্যবহার করতে পারছে। শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবে হাতে-কলমে কম্পিউটার সম্পর্কিত নানা বিষয় শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। শহরের একটু দূরে অবস্থিত এমনই একটি বিদ্যালয় ঠাকুরগাঁও রোড বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম আর শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবে ক্লাস করছেন শিক্ষার্থীরা। এসব ব্যবহার করে স্মার্ট নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠছেন তারা। শিক্ষার্থীরা জানান, স্কুলে এলে ল্যাপটপে ক্লাস করানোর সময় ইউটিউব বা গুগলে সার্চ করে কাক্সিক্ষত বিষয়টি আমরা পেয়ে যাই। আমরা আগে শুধু পড়তাম। এখন নিজেই নিজেদের সমস্যাগুলো সমাধান করছি।

জেলাটিতে বেড়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা। কমেছে ঝড়ে পড়া। বেড়েছে শিক্ষার হার। এছাড়া ঠাকুরগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও ড. এম ওয়াজেদ মিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপনের কাজ চলমান আছে। যা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে জেলার উন্নয়ন আরো তরান্বিত হবে।

যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন : ২০০৫-৬ সালে ঠাকুরগাঁও জেলায় গ্রামীণ রাস্তার পরিমাণ ছিল মাত্র ৪৪৫ কিলোমিটার। যার বেশিরভাগই ছিল কাঁচা এবং আধাপাকা। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর গত সাড়ে ১৪ বছরে শুধুমাত্র এলজিইডি নির্মাণ করেছে ১৬শ কিলোমিটার পাকা রাস্তা। ২০০৬ সালে জেলায় ব্রিজ-কালভার্ট ছিল ২ হাজার ১৫৬টি। বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ১৮৭টি। সড়ক ও জনপদ বিভাগের মাধ্যমে ঠাকুরগাঁও জেলায় পাকা রাস্তা হয়েছে ১২০ কিলোমিটার। ব্রিজ ও কালভার্ট হয়েছে ২০টি। স্থানীয়রা বলছেন, স্থানীয় বাসিন্দা জমির উদ্দিন বলেন, ঠাকুরগাঁও জেলা এখন আর আগের মতো নেই। অনেক উন্নত হয়েছে। রাস্তাঘাট পাকা হয়েছে। ব্রিজ-কালভাট হয়েছে। আগে যে জমি ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা শতক ছিল। এখন সেই জমির শতক হয়েছে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। যতই দিন যাবে, জমির দাম ততই বাড়বে। আমরাও উন্নত হচ্ছি।

জঙ্গি তৎপরতা এখন আর নেই : একসময় জঙ্গিরা এ অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়ে তৎপরতা চালাত। জেলার রাণীশংকৈল উপজেলায় জঙ্গি আস্থানা ছিল। ফলে আতঙ্কে থাকতেন এলাকার মানুষ। উন্নয়নের ছোঁয়ায় রাণীশংকৈল এখন বদলে গেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, শিল্প, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, সামাজিক নিরাপত্তাসহ সব খাতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থান, সমৃদ্ধ হচ্ছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনীতি। ঠাকুরগাঁও জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, জেলায় জঙ্গিসংক্রান্ত মামলা ছিল ৭টি। একটি নিষ্পত্তি হয়েছে। ছয়টি বিচারাধীন। মোট আসামি ৯৪ জন। এর মধ্যে জামিনে আছেন ৭৪ জন, পলাতক ২ জন, জামিনে পলাতক ২ জন, মারা গেছেন ৫ জন ও খালাস পেয়েছেন ১ জন। পঞ্চগড় ও রংপুর কারাগারে ৫ জন করে আটক আছে। বর্তমানে ঠাকুরগাঁওয়ের কোনো এলাকাতেই জঙ্গি আস্তানা কিংবা ঘাঁটি নেই। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুবই তৎপর। তাছাড়া জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো।

শতভাগ ভূমি ও গৃহহীনমুক্ত জেলা : প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ঠাকুরগাঁওকে শতভাগ ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত জেলা করা হয়েছে। গত ৯ আগস্ট এ জেলাকে ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ে মোট ৮ হাজার ১৮৭ জন ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারের মধ্যে জমি ও ঘর দিয়েছে সরকার। আশ্রয়ণের ঘরপ্রাপ্ত পরিবারগুলোকে দক্ষ করে গড়ে তুলে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মমুখী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চলমান আছে।

কৃষি উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ : ঠাকুরগাঁও কৃষিপ্রধান জেলা। প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক কারণে জেলায় ধানের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণ গম, ভুট্টা, আলু, পাট, শাক-সবজি, সরিষা, চীনা বাদাম, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, আদা, হলুদসহ আরো নানা ধরনের রবিশস্য ও তৈলবীজের চাষ হয়। কিন্তু জেলার কৃষিপণ্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছানোর ব্যবস্থা ছিল খুবই অপ্রতুল। কারণ গ্রাম থেকে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য জেলা শহরে নিয়ে আসবে, সেই ব্যবস্থাও ছিল না। কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই খারাপ। অন্য জেলাতে তা পাঠানো ছিল আরো দুষ্কর। এখন আমূল পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে জেলার কৃষিপণ্য জেলা শহর পেরিয়ে রাজধানী এমনকি দেশের বাইরেও রপ্তানি হচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঠাকুরগাঁও থেকে আলু, আম ও করলা বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। বর্তমান সরকারের নানামুখী যুগোপযোগী ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি ব্যবস্থাপনার ফলে বর্তমানে জেলার মোট আবাদি জমির পরিমাণ ও কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন গত দুই দশকে বেড়েছে বহুগুণ। এছাড়া ২০০৫-৬ সালে জেলায় চা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল শুন্যের কোঠায়। বর্তমানে জেলায় ১ হাজার ৪৫৭ একর জমিতে চা চাষ করা হচ্ছে। যা জেলার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এর বাইরেও রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত অঞ্চল স্থাপন করা হচ্ছে। ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান জানান, এক সময় প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষের উৎপাদিত ফসল পঁচে যাওয়ার মতো ছিল। এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় সহজে নেয়ার তেমন সুযোগ ছিল না। ঢাকাতে নেয়ার সুযোগ তো আরো ছিল না। এখন সেই অবস্থা আর নেই। বর্তমানে একেইবারে গ্রামীণ জনপদেও পাকা রাস্তা হয়েছে। যার ফলে মানুষ তাদের উৎপাদিত ফসল শহরে আনতে পারছে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরেও রপ্তানি করছে।


শেয়ার করুন