২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১২:১৪:৪৫ অপরাহ্ন
ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য জটিলতার মুখে বাংলাদেশ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-০৯-২০২৩
ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য জটিলতার মুখে বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির রেশ কাটতে না কাটতেই এবার বাণিজ্যের দায় শোধেও জটিলতায় পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব ফরেন অ্যাসেট কন্ট্রোল (ওএফএসি) সে দেশের ব্যাংকগুলোকে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন বা আকুর সঙ্গে সম্পর্কিত লেনদেন নিষ্পত্তি না করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। আকুর সদস্য হিসেবে বাংলাদেশকেও এ জন্য ভুগতে হবে। বিশেষ করে আকুর সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশ বাকিতে আমদানি দায় পরিশোধের যে সুযোগ পেয়ে আসছিল, তা এখন অনিশ্চয়তায় পড়বে। বাধ্য হয়ে নগদে আমদানি দায় শোধ করতে হবে বাংলাদেশকে, যা ডলার-সংকটের এই সময়ে বেশ কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।


আকু মূলত একটি আন্ত-আঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তিকারী সংস্থা। আকুর সদস্যদেশ হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। এর প্রধান কার্যালয় ইরানের রাজধানী তেহরানে। আকুর মাধ্যমে লেনদেনের সুবিধা হলো সদস্যদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে লেনদেনের পুরো অর্থ পরিশোধ করতে হয় না, বরং পরস্পরের কাছে তাদের ঠিক কী পরিমাণ দেনা আছে, তা বাদ দিয়ে বাকি অর্থ পরিশোধ করা যায়। সংগঠনটির ৯ দেশের মধ্যে আমদানি বিল সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের মাধ্যমে দুই মাস পরপর পরিশোধ করা হয়।


আকুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো লেনদেন নিষ্পত্তি না করতে ওএফএসি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে, তাতে রীতিমতো হুমকিতে পড়েছে বাংলাদেশ-ভারতসহ ৯ দেশের আন্তবাণিজ্য।


বিশ্লেষজ্ঞরা বলছেন, ডলারে দায় শোধে বাধার কারণে ভারতের সঙ্গে বন্ধ হয়ে যেতে পারে সব ধরনের বাণিজ্য। বিকল্প মুদ্রা হিসেবে রুপি ও ইউরোতে লেনদেনের সুযোগ আছে বটে, কিন্তু বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে যে পরিমাণ আমদানি করে, সে পরিমাণ রুপি বা ইউরো বাংলাদেশের হাতে নেই। এতে ঝুঁকিতে থাকা ডলার মজুতে আরও চাপ পড়বে।


অর্থনীতি বিশ্লেষক ও পিডব্লিউসির কান্ট্রি পার্টনার মামুন রশীদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ইরান আর মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশন রয়েছে। ফলে এখন যে আকুর লেনদেন নিষ্পত্তিতে স্যাংশন দেওয়া হয়েছে, তাতে আমাদের ওপর এর প্রভাব বেশ নেতিবাচক হবে। কারণ, বাংলাদেশ আকুর সুবিধা নিয়ে আমদানি দায় বাকিতে শোধ করতে পারে। আমরা আমদানিকারক দেশ হওয়ায় ব্যাপক আমদানির কারণে দায় বাকিতে শোধ করার কারণে বেশ লাভ ছিল। এ নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের ক্ষতি হবে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে ভারতের। দেশটির রপ্তানি কমবে। আমাদের ক্ষতিটা হলো এমন—আগে ভারত থেকে আমদানি করে পরে দায় শোধ করা যেত, এখন সেই আমদানিটা যদি অন্য দেশ থেকে করতে হয়, তবে নগদে ডলারে করতে হবে। এত ডলার বাংলাদেশ কোথায় পাবে? আমাদের তো ডলার নেই। যেহেতু আমরা ডলার হাংরি কান্ট্রি।’


তথ্য-উপাত্ত বলছে, আকুর সদস্য ৯ দেশের মধ্যে শুধু ভারতই নিয়ন্ত্রণ করে ৯৩ শতাংশ বাণিজ্য। আকুর সদস্যভুক্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের গত ছয় মাসের গড় লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় বিলিয়নের বেশি। তার মধ্যে শুধু ভারত থেকে ৯২ থেকে ৯৫ শতাংশ আমদানি করা হয়। আর ভুটান, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা থেকে আমদানি করা হয় মাত্র ৫-৮ শতাংশ।


ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ এখন ১৬ বিলিয়ন  ডলার। বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করে কমবেশি এখন ২ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ। ফলে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১৪ বিলিয়ন ডলার। ডলারে লেনদেন বন্ধ হয়ে গেলে, উভয় দেশে রুপিতে লেনদেনের চুক্তি করায় মাত্র ২ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ভারতের আমদানি বিলেই মূলত আকুর বিল হিসেবে ডলারে পরিশোধ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে বিপুল অঙ্কের বাণিজ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আর এটা হলে নিত্যপণ্যসহ বিভিন্ন দরকারি পণ্যের দাম এবং জীবনযাত্রায় আরেক দফা প্রভাব পড়তে পারে।


বাংলাদেশ-ভারত চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল মাতলুব আহমাদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এটা মূলত একটা ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতসহ বেশ কিছু দেশ ডলার থেকে বেরিয়ে এসে অন্য মুদ্রায় লেনদেন বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি হয়তো ভালোভাবে নেয়নি। সে কারণে এটা চাপ হতে পারে। তবে আমি মনে করি, আকু একটি পুরোনো পদ্ধতি। এটার নিষ্পত্তি ডলারেই হয়। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এখানে তো ডলারের আধিপত্য কমছে না। বিষয়টি শিগগির ঠিক হয়ে যাবে আশা করি।’


আকুর  ৯ দেশের মধ্যে আমদানি বিল সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের মাধ্যমে দুই মাস পরপর পরিশোধ করা হয়। সর্বশেষ চলতি মাসে আকু বিল বাবদ ১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জুলাইতে আকুর আমদানি বিল ছিল ১ দশমিক শূন্য ৯ বিলিয়ন ডলার।


ডলার যে হারে কমছে, তাতে এরই মধ্যে তা আইএমএফের ঋণের শর্তের মাত্রা ২৪ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে কমে ২১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সামনে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তিও আটকে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।


এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘তেহরানভিত্তিক আকুতে লেনদেনের ভারতের ব্যাংকের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, সেই বিষয়ে আমরা এখনো পরিষ্কার ধারণা পাইনি। আকুর সেক্রেটারিয়েট (ব্যবস্থাপনা কমিটি) এ বিষয়ে তাদের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিশ্চিত হয়ে সদস্যদেশগুলোকে জানাবে। এরপর এই বিষয়ে কথা বলা যাবে। তবে যদি আকুর মাধ্যমে পেমেন্ট না করা যায়, তাহলেও তেমন কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে সুইফটের মাধ্যমে বিল পরিশোধ করা হবে।’


শেয়ার করুন