২৫ নভেম্বর ২০২৪, সোমবার, ১১:৫৫:৪১ পূর্বাহ্ন
ঘরের আগুনে পুড়ছে আ.লীগ, নতুন মুখের সন্ধানে বিএনপি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-১০-২০২৩
ঘরের আগুনে পুড়ছে আ.লীগ, নতুন মুখের সন্ধানে বিএনপি

নাটোরের ৪টি সংসদীয় আসনের তিনটিতেই অন্তর্কোন্দলে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা। ঘরের আগুনেই পুড়ছে সংগঠনটি। দলটির অর্ধশত নেতা নৌকার মনোনয়নের প্রত্যাশায় মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।


প্রার্থী বেশি হওয়ায় এবার মনোনয়নবঞ্চিতরাই নৌকার পরাজয়ের কারণ হতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্যদিকে নাটোরে বিএনপির প্রার্থী কম। নাটোর-২ (সদর) আসন বাদে বাকি ৩টিতেই বিএনপির নতুন মুখ আসছে-এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে।


এর মধ্যে নাটোর-১ ও ৪ আসনে বিএনপির সাবেক সংসদ-সদস্য ফজলুর রহমান পটল ও মোজাম্মেল হকের মৃত্যুতে নতুন মুখ আসছে, এটা নিশ্চিত। এছাড়া নাটোর-৩ আসনে বিএনপি প্রায় নেতৃত্বশূন্য। এ সুযোগে বিএনপি অধ্যুষিত এ এলাকার নিয়ন্ত্রণ এখন আওয়ামী লীগের হাতে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ সাবেক সংসদ-সদস্য কাজী গোলাম মোর্শেদ বেশির ভাগ সময় থাকেন অসুস্থ।


যদিও তিনি এ শরীর নিয়েও নেতাকর্মীদের চাঙা করতে মাঠে আছেন। নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। তিনবারের সংসদ-সদস্য হলেও গত নির্বাচনে তিনি অসুস্থ থাকায় মনোনয়ন দেওয়া হয় দাউদার মাহমুদকে। তিনি নির্বাচনে ফেল করায় এ আসনে মনোনয়ন নিয়ে নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছে।


তবে বিএনপি শেষ পর্যন্ত এবারের সংসদ নির্বাচনে যায় কি না, এ নিয়ে সংশয় থাকায় কৌশলে ধীরে চল নীতিতে প্রচার চালাচ্ছেন তারা। জাতীয় পার্টি ও ওয়ার্কার্স পার্টির প্রকাশ্যে স্বল্পবিস্তর তৎপরতা থাকলেও জেলার তিনটি আসনে জামায়াত প্রার্থীরা নানা কৌশলে প্রচার চালাচ্ছেন।


(সরেজমিনে তথ্যসহ প্রতিবেদনটি প্রস্তুতে সহযোগিতা করেছেন সাইফুল ইসলাম-সিংড়া, সাহীন ইসলাম-লালপুর, মঞ্জুরুল আলম মাসুম-বাগাতিপাড়া, অহিদুল হক-বড়াইগ্রাম ও ডিএম দিলু-গুরুদাসপুর)।


নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) : এ আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলেই আছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। বিএনপিতে থানা কমিটি নিয়ে বিরোধ রয়েছে। আওয়ামী লীগে বর্তমান সংসদ-সদস্য শহিদুল ইসলাম বকুল ও সাবেক সংসদ-সদস্য আবুল কালাম আজাদ অনুসারীদের পৃথক কমিটি রয়েছে প্রতিটি ইউনিয়নে। আওয়ামী লীগের কর্মসূচি লালপুরে চারভাগে এবং বাগাতিপাড়ায় তিনভাগে পালিত হয়।


বাগাতিপাড়ায়ও বিএনপির আলাদা কর্মসূচি হয়। এ আসনে নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী ১৩ নেতা। অপরদিকে প্রকাশ্যে নির্বাচনি তৎপরতা না থাকলেও ঘরোয়াভাবে সক্রিয় রয়েছেন বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থীরা। বর্তমান সংসদ-সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শহিদুল ইসলাম বকুল জানান, পাঁচ বছরের কর্মকাণ্ড, সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধসহ নানা উন্নয়নের জন্য তিনিই এবার নৌকার মনোনয়ন পাবেন বলে আশা করছেন।


তবে নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাবেক সংসদ-সদস্য আবুল কালাম আজাদ মনে করেন, বর্তমান সংসদ-সদস্য দলের মধ্যে ব্যাপকভাবে কোন্দলের জন্ম দিয়েছেন। তাই বর্তমান সংসদ-সদস্যকে বাদ দিয়ে তাকে মনোনয়ন দেবে কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড।


এছাড়া নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী বাগাতিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস, সাবেক সংসদ-সদস্য মমতাজ উদ্দিন ও শেফালী মমতাজ দম্পতির সন্তান লালপুর থানা আওয়ামী লীগের সম্পাদক শামীম আহমেদ সাগর, কর্নেল (অব.) রমজান আলী, লালপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ইসাহক আলী, লালপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফতাব হোসেন ঝুলফু, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আনিসুর রহমান, কৃষিবিষয়ক সম্পাদক আতিকুর রহমান আতিক, বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক কাজল রায়, ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা আরিফুল ইসলাম উজ্জ্বল, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা প্রধান শিক্ষক হুমায়ন কবির ও বাগাতিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আবুল হোসেন।


এদিকে নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে এ আসনে মনোনয়ন চাইবেন সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত ফজলুর রহমান পটলের স্ত্রী জেলা বিএনপির সদস্য অধ্যক্ষ (অব.) কামরুন্নাহার শিরিন। মনোনয়ন চাইবেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি তাইফুল ইসলাম টিপু। জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক সংসদ-সদস্য এমএ তালহা। তিনি ২০০৮ সালে মহাজোটের হয়ে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিলেন তিনি।


পরে জোটের সিদ্ধান্তের কারণে সরে দাঁড়ান। সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী আশিকুর রহমান, নাটোরের আইনজীবী সোহেল রানা ও প্রভাষক সাহীন ইসলাম জাতীয় পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশী। এ আসনে সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াত। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থী জেলা সভাপতি অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খলিল এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রার্থী হতে চান গোপালপুর সাবেক মেয়র মনজুরুল ইসলাম বিমল।


নাটোর-২ (সদর-নলডাঙ্গা) : এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য কোন্দলে মারধর ও পালটাপালটি মামলার ঘটনা ঘটছে আহরহ। এর মাঝেই সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নের আশায় মাঠে কাজ করছেন বর্তমান সংসদ-সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শফিকুল ইসলাম শিমুল। নির্বাচনে তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম রমজান।


নৌকার অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সিরাজুল ইসলাম, সহসভাপতি সাবেক ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার, সহসভাপতি নাটোর পৌর মেয়র উমা চৌধুরী জলি, যুগ্মসম্পাদক নাটোর বারের সম্পাদক আব্দুল মালেক শেখ ও সৈয়দ মোর্তজা আলী বাবুল, সাংগঠনিক সম্পাদক রাবি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এমরান সোনার, সংরক্ষিত সংসদ-সদস্য ও জেলা মহিলা লীগের সভাপতি রত্না আহমেদ এবং জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি ইসতিয়াক আহমেদ ডলার। ধানের শীষের মনোনয়ন চাইবেন কারাবন্দি বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক উপমন্ত্রী এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু।


এ আসন থেকে তিনি টানা তিনবার সংসদ-সদস্য হয়েছেন। শেষবার তিনি স্থানীয় সরকার ও পরে ভূমি উপমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মামলার কারণে গত দুই সংসদ নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হতে পারেননি। এবার প্রার্থী হতে না পারলে গত দুই নির্বাচনের মতোই দলের মনোনয়ন চাইবেন তার স্ত্রী জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি সাবিনা ইয়াসমিন ছবি। প্রার্থী যেই হোন না কেন, দুলু পরিবারের বাইরে যাবে না নাটোর সদরের আসনের মনোনয়ন-এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে। জাতীয় পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থী জেলা যুগ্ম আহ্বায়ক সাবেক অতিরিক্ত সচিব ড. নুরুনবী মৃধা। তিনি নাটোর পৌরসভার মেয়র ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে গত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সম্মানজনক ভোট পেয়েছিলেন। জামায়াতের প্রার্থী সাবেক আমির অধ্যাপক মো. ইউনুস আলী।


নাটোর-৩ (সিংড়া) : বিএনপির ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত এ এলাকা এখন প্রায় নেতৃত্বশূন্য। বিএনপির বিরোধের সুযোগে ১৯৭৩ সালের পর প্রথমবারের মতো নৌকার মনোনয়নে সংসদ-সদস্য হন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তিনি প্রতিটি ইউনিয়ন, ওয়ার্ডে কমিটি গঠনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনকে সক্রিয় করেছেন। দলকে সংগঠিত করার পাশাপাশি এলাকায় উন্নয়নের কারণে এবারও নৌকার মনোনয়ন পাবেন বলে আশা করেন পলক। তবে অওয়ামী লীগের মনোনীত উপজেলা চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলামের অভিযোগ, গত নির্বাচনে তাকে ফেল করানোর জন্য বিএনপি নেতা আদেশ আলীকে দলে এনে তার বিরুদ্ধে ভোট করিয়েছেন পলক।


এসব অভিযোগে এবার পলক নন, তিনিই দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন। এ আসনে নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী আওয়ামী লীগ মনোনীত তিনবারের সংসদ-সদস্য প্রার্থী প্রয়াত শাহজাহান আলীর ছেলে উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সরফরাজ নেওয়াজ বাবু, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ১৯৭০ ও ১৯৭৩-এর নির্বাচনে নৌকার বিজয়ী সংসদ-সদস্য আশরাফুল ইসলামের ছেলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্মসম্পাদক অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম দুলু।


এ আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক তিনবারের সংসদ-সদস্য অধ্যাপক কাজী গোলাম মোর্শেদ, সিংড়া উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যক্ষ আনোয়ারুল ইসলাম আনু, সদস্য সচিব দাউদার মাহমুদ, জাতীয়তাবাদী কেন্দ্রীয় প্রজন্ম দলের সম্পাদক ও উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ব্যারিস্টার ইউসুফ আলী। উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি প্রকৌশলী আনিসুর রহমান লাঙ্গলের মনোনয়নপ্রত্যাশী। ইসলামী আন্দোলন থেকে উপজেলা সেক্রেটারি শাহ্ মোস্তফা ওয়ালীউল্লাহ, ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজান প্রার্থী হতে চান।


নাটোর-৪ (বড়াইগ্রাম-গুরুদাসপুর) : সাবেক সংসদ-সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস এবং সাবেক সংসদ-সদস্য বিএনপি নেতা অধ্যাপক মোজাম্মেল হক মারা যাওয়ায় এবার আসনটিতে উভয় দলেই নতুন মুখের ছড়াছড়ি। গত উপনির্বাচনে বিনা ভোটে সংসদ-সদস্য হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক ও বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান ডা. সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী।


এবারও তিনি মনোনয়নপ্রত্যাশী। নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্যরা হলেন প্রয়াত সংসদ-সদস্য আব্দুল কুদ্দুসের ছেলে আসিফ আব্দুল্লাহ বিন কুদ্দুস শোভন ও মেয়ে যুব মহিলা লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি কোহিলী কুদ্দুস মুক্তি, গুরুদাসপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সম্পাদক ও তিনবারের মেয়র শাহনেওয়াজ আলী মোল্লা, বনপাড়ার তিনবারের মেয়র কেএম জাকির হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আহম্মদ আলী মোল্লা, গুরুদাসপুর উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন, গুরুদাসপুর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম জাহিদ ও ব্যারিস্টার সুব্রত কুমার কুন্ডু।


নির্বাচনে অংশ নেওয়ার নির্দেশনা পেলে এ আসনে গুরুদাসপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ ধানের শীষের মনোনয়ন চাইবেন। এছাড়া বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী কেন্দ্রীয় সহ-ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মি. জন গমেজ ও প্রয়াত সংসদ-সদস্য অধ্যাপক মোজাম্মেল হকের ছেলে ব্যারিস্টার আবু হেনা মোস্তফা কামাল রঞ্জু।


এছাড়া জাতীয় পার্টির সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক সংসদ-সদস্য আবুল কাশেম সরকার ও জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি শিল্পপতি অধ্যাপক আলাউদ্দিন মৃধা লাঙ্গলের মনোনয়ন চাইছেন। জেলা জামায়াতের প্রার্থী হয়েছেন মাওলানা আব্দুল হাকিম।


শেয়ার করুন