০১ মে ২০২৪, বুধবার, ০৬:১৭:২৪ পূর্বাহ্ন
নিহত চিকিৎসক কাজেমের শিশু সন্তানের প্রশ্ন-‘আব্বু আমাকে খাইয়ে দিবে না’
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩১-১০-২০২৩
নিহত চিকিৎসক কাজেমের শিশু সন্তানের প্রশ্ন-‘আব্বু আমাকে খাইয়ে দিবে না’

সোমবার দুপুর দেড়টা। রাজশাহী নগরীর উপশহর এলাকার দুই নম্বর সেক্টরের একটি রাস্তার দুই পাশে পাশাপাশি কয়েকটি বাড়ি। চার নম্বর ওই রাস্তার দুই পাশে গাছের ছায়ায় চেয়ার পেতে বসে ছিলেন জনাত্রিশেক মানুষ। একটু দূর থেকে দেখে বুঝা যায়, সবার মুখে তেমন কোনো কথা নাই। শোকে স্তবদ্ধ যেন সবাই। কাছে যেতেই একজনকে আস্তে আস্তে বলতে শোনা গেলো, ‘তার (রাজশাহী নগরীর বর্ণালীর মোড়ে ছুরিকাঘাতে নিহত চিকিৎসক কাজেম আলী) তো কোনো শত্রæ ছিল না। এতো সহজ-সরল মানুষকে কারা মেরে ফেললো এভাবে? যারা এমন ঘটনা ঘটালো মাসুম তিনটা বাচ্চাকে এতিম করে দিল আল্লাহয় তাদের বিচার করবে। এর ধরা পড়বেই। আল্লাহ এই অপরাধ সহ্য করবেন না।’


অর্ধ বয়স্ক জামাল উদ্দিন নামের ওই ব্যক্তি এ প্রতিবেদকে চিনিয়ে দেন নিহত চিকিৎসক কাজেম আলী আহমেদের বাড়ি। তাঁর দেখানো বাড়ির তিন তলায় উঠে গিয়ে দেখা যায় ভিতরে ৪০-৫০ জন নারী। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ চোখের পানি মুচছেন, তো কেউ কে হাউমাউ করে কাঁদছেন। চিকিৎসক কাজেম আলীর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে একজন নারী বলেন, ‘উনি তো কথা বলতেই পারছেন না। রাত থেকে কেঁদে কেঁদে আর কথা বলতে পারছে না। শুধু চেয়ে থাকছেন সবার দিকে।’


কাছে গিয়ে এ প্রতিবেদক কথা বলার চেষ্টা করেও কাজেম আলীর চিকিৎসক স্ত্রী (রামেক হাসপাতালের ফার্মাকোলজি বিভাগের চিকিৎসক) ফারহানা ইয়াসমিন চেষ্টা করেও যেন কথা বলতে পারছিলেন না। শুধু বললেন, ‘আমার তিন সন্তানের এখন কি হবে। বাবা ছাড়া তো ওরা কিছুই বুঝত না। আমি ওদের এখন কিভাবে মানুষ করবো?’


এরই মধ্যে ছোট ছেলে সাম্মী আবরার (৭) এসে মাকে বলতে থাকে, ‘আম্মু আব্বু কখন আসবে? আজকে আব্বু আমাকে খাইয়ে দিবে না?’ ছোট ছেলের এমন কথায় আবারো হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন মা ফারহানা ইয়াসমিনসহ অন্যরাও। এদিকে বড় ছেলে আবরার ফারহান আহমেদের জনা দশেক সহপাঠি খবর পেয়ে ছুটে এসেছে আবরারকে শান্তনা দিতে। কিন্তু তারাও কাঁদতে শুরু করে সাম্মীর সেই কথায়। আবরার রাজশাহীর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র।


কাজেম আলীর দুই ছেলে এক মেয়ে। মেজেটা মারিয়া ইয়াসমিন বড় ভাই আবরারের স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। মারিয়াও গতকাল স্কুলে যেতে পারেনি বাবা কাজেম আলীর মৃত্যুর ঘটনায়। সেও কেঁদে কেঁদে দুচোখ লাল করে ফেলেছে।


ওই বাড়ির দরজার কাছেই বসেছিলেন কাজেম আলীর চেম্বারের এ্যাসিসটেন্ট বিপ্লব হোসেন। তিনি বলেন, ‘স্যার সপ্তাহের তিন দিন ইসলামী ব্যাংক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং তিনদিন পপুলার ডায়াগোনস্টিক সেন্টারে প্র্যাক্টিস করেন। তাঁর মতো ভালো মানুষ হয় না। আমি ১০ বছর ধরে স্যারের সঙ্গে আছি। কখনোই কারো সঙ্গে খারাপ আচরণ বা কোনো দ্ব›দ্ব হয়েছে বলে শুনিনি। এমন মানুষকে কেন মারা হলো বুঝতে পারছি না।’


বিপ্লব বলেন, স্যারকে প্রায় তিন বছর ধরে রাতে মোটরসাইকেলে করে বাড়িতে পৌঁছে দেন গ্লোবাল ফার্মাসিউটিক্যালসের রিপ্রেজেনটিভ। সেও স্যারের খুব বিশ^স্ত। খুব ভালো মানুষ। স্যারকে রাতে কখনোই একা বড়িতে আসতে দিতেন না। বৃষ্টি হলে অটোরিকশাতে করে হলেও স্যারকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তার পর শাহীনুজ্জামান বাড়ি যেতেন। রবিবার রাতেও তিনিই মোটরসাইকেলে করে বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছিলেন। কিন্তু সন্ত্রাসীরা আর বাড়িতে ফিরতে দেননি স্যারকে। যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের শাস্তি চাই আমি।’


বিপ্লব জানান, বিকেল চারটার পরে রোগী দেখতে শুরু করতেন চিকিৎসক কাজেম আলী। প্রতিদিন রোগীর চিকিৎসা দিতে দিতে রাত ১২টা পার হয়ে যেত। তবে রবিবার হরতাল থাকায় সাড়ে ১১টার মধ্যে রোগী দেখা শেষ হয়ে যায়। এর পরে শাহীনুজ্জামানের সঙ্গে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন কাজেম আলী। কিন্তু পথেই দুর্বৃত্তদের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নিহত হন কাজেম আলী।


কাজেম আলীর বাবা গোলাম মোর্তজা মন্টু। তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। কাজেম আলীরা দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে কাজেম আলীই সবার ছোট। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে পড়া-লেখা শেষ করে এখানেই চাকরিতে প্রবেশ করেন তিনি। এর পর আর গ্রামে ফিরে যাননি। শহরেই করেন বাড়ি। ছেলের মত্যুর খবর পেয়ে বাবা গোলাম মোর্তজাও গতকাল ছুটে এসেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের দেবিনগর ইব্রাহিম মÐলের টলা গ্রাম থেকে ছেলের লাশ দেখতে।


এই প্রতিবেদককে গোলাম মোর্তজা বলেন, আমরা ছেলের কোনো শত্রু ছিলো না। সে শহরে থাকলেও আমার সঙ্গে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। প্রায় প্রতিদিন একবার হলেও ফোন দিন। কিন্তু আজকে থেকে ছেলে আমাকে আর ফোন দিবে না। আমার ভালো ছেলেকে যারা হত্যা করেছে, আমি তাদের দ্রæত বিচার চাই।’


 


শেয়ার করুন