দেশে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্প। এ শিল্পে কর্মরত লাখ লাখ শ্রমিকের শ্রম-ঘামে অর্জিত বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশের অর্থনীতির বড় শক্তি। কিন্তু যাঁদের দিনরাত খাটুনিতে রপ্তানি বাণিজ্যের চাকা ঘুরছে, অর্থনীতি বড় হচ্ছে–সেই শ্রমিকদের কোনো উন্নতি নেই। পাঁচ বছর আগে নির্ধারণ করা ৮ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি নিয়েই চরম কায়ক্লেশে দিন কাটে তাঁদের। অথচ এই পাঁচ বছরে তাঁদের বাড়িভাড়া বেড়েছে পাঁচবার, নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। খরচ বৃদ্ধির জাঁতাকলে দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে নিম্নতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা করতে আন্দোলনে নেমেছেন শ্রমিকেরা।
কিন্তু তাঁদের এই দাবি মানতে নারাজ মালিকপক্ষ নিম্নতম মজুরি কিছুটা বাড়িয়ে ১০ হাজার ৪০০ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে। মালিকদের এই প্রস্তাবকে অমানবিক বলছেন শ্রমিকেরা, আর বিশ্লেষকেরা বলছেন অন্যায্য।
পোশাকশিল্পে সর্বশেষ ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় ২০১৮ সালে। সে সময় গঠিত মজুরি বোর্ড শ্রমিকদের সাতটি গ্রেডে ভাগ করে মজুরি চূড়ান্ত করে দেয়, যা পরে গেজেট আকারে প্রকাশ করে সরকার। এতে গ্রেড-৭-এর অন্তর্ভুক্ত শ্রমিকদের (হেলপার) মোট মজুরি নির্ধারণ করা হয় ৮ হাজার টাকা। আর গ্রেড-১-এ থাকা সর্বোচ্চ দক্ষ শ্রমিকদের (যেমন চিফ কোয়ালিটি কন্ট্রোলার) মোট মজুরি ধরা হয় ১৮ হাজার ২৫৭ টাকা।
২০১৮ সালের পর পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি আর বাড়েনি। এর আগে ২০১৩ সালে ৫ হাজার ৩০০ এবং ২০১০ সালে শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ঠিক করে দেওয়া হয় ৩ হাজার টাকা। প্রতিবারই মজুরি নির্ধারণ নিয়ে আন্দোলনে যেতে হয়েছে শ্রমিকদের। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।
জানা গেছে, পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে গতকাল বুধবারও সভা করেছে মজুরি বোর্ড। সভা শেষে মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মালিকপক্ষ নতুন মজুরির প্রস্তাব দেবে। চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে মজুরি চূড়ান্ত হবে। আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে নতুন মজুরিকাঠামো কার্যকর হবে।
শ্রমিক আন্দোলনের উত্তাল পরিস্থিতে গতকাল মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জরুরি সভা করে মজুরি বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছে। আগে ১০ হাজার ৪০০ টাকা ন্যূনতম মজুরির যে প্রস্তাব করা হয়েছিল, তা থেকে সরে এসে এখন মজুরি আরও বাড়ানোর পক্ষে সায় দিয়েছে সংগঠনটি। পোশাকশিল্পের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠিত ওই জরুরি সভায় বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘আমরা তৈরি পোশাকশ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর জন্য যে প্রস্তাব মজুরি বোর্ডে দিয়েছি, সেটা খুবই প্রাথমিক। সেখানে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাড়ানোর সুযোগ আছে।’ তিনি বলেন, পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা কাজ না করে ভাঙচুর ও বিশৃঙ্খলা করলে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হবে। তখন তাঁরা বেতন পাবেন না।
নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে শ্রমিকেরা যেমন কষ্টে আছেন, তেমনি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে প্রধান বাজারগুলোয় পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ায় এই খাতের ব্যবসাও ভালো যাচ্ছে না বলে দাবি করেছেন শিল্পমালিকেরা। তাঁরা বলছেন, শিল্পের কাঁচামালের দাম বেড়েছে। ডলারের দর বাড়ায় খরচও বেড়েছে। কিন্তু উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও ক্রেতারা পোশাকের দাম কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়ায়নি। এতে পোশাকশিল্পকেও টিকে থাকার সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
মালিকেরা পোশাকের দাম কম পাওয়ার যে দাবি করেন, তার সমর্থনে সুনির্দিষ্ট তথ্য তাঁরা দেন না। এ নিয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো গবেষণাও নেই। ফলে এটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে তৈরি পোশাক রপ্তানির লাভের বিষয়টি সব সময় মালিকপক্ষ গোপন রাখতে চায়। তাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা কখনো প্রকাশ করা হয় না। এই কারণে রপ্তানির বিপরীতে লাভের পরিমাণ কত, সেটা পরিমাপ করা খুবই কঠিন। আমরা সব সময় শুনি তাদের তেমন কোনো লাভ হচ্ছে না; কিন্তু প্রতিবছর দেখা যায় রপ্তানি বাড়ছে।’
তথ্য-উপাত্ত বলছে, ডলারের বাড়তি দরে কিছু সুবিধাও পেয়েছেন মালিকেরা। এ সুবিধার একটি অংশ কর্মীদের পাওয়ার সুযোগ ছিল বলে নানান মহল থেকে আলোচনা রয়েছে। জানা যায়, ২০১৮ সালে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা। তখন ন্যূনতম মজুরি ছিল ৮ হাজার টাকা বা ৯৫ ডলার ৩৫ সেন্ট। এখন ডলারের দর ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। ডলারের বিনিময় হার হিসাব করলে আগের মজুরি বেড়ে এখন ১০ হাজার ৫৩৬ টাকা হওয়ার কথা।
পোশাকশ্রমিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আখতার আজকের পত্রিকাকে বলেন, বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যে দাম, তার সঙ্গে তুলনা করলে তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা দাবি খুবই ন্যায্য। সর্বশেষ মজুরি বৃদ্ধির পর গত পাঁচ বছরে বাসাভাড়া বেড়েছে পাঁচবার। আগে শ্রমিকেরা যে চাল ৪০ টাকা কেজি কিনতেন, এখন তা কিনতে হচ্ছে ৬৫ টাকায়। ৩০ টাকার পেঁয়াজের দাম বেড়ে হয়েছে ১৩০ টাকা। নিত্যপ্রয়োজনীয় এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি। সেই তুলনায় শ্রমিকদের বেতন বাড়েনি।
শ্রমিকনেতা ও জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মো. আমিরুল হক আমিন বলেন, ‘আমরা ২৩ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি করার যে প্রস্তাব দিয়েছি, সেটার বিপরীতে মালিকপক্ষ যেটা প্রস্তাব করেছে, তা খুবই অবমাননাকর।’
বেতনের দাবিতে শ্রমিকদের বিদ্যমান আন্দোলনে আশুলিয়ায় অবস্থিত হা-মীম গ্রুপের চারটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, এমন তথ্য জানিয়ে হা-মীম গ্রুপের এমডি ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, বর্তমানে যে অস্থিরতা চলছে, তাতে কারখানা খোলা রাখা খুবই কঠিন।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘পাঁচ বছর পরপর মজুরি বোর্ডের সভা বসে। কিন্তু নির্বাচনের আগে হওয়ায় দেশি-বিদেশি একটি চক্র এই সময়ের সুযোগ নিতে চাইছে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের কর্মকাণ্ডও বেড়ে গেছে। অনেকেই ষড়যন্ত্র করছে আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ডকে কেন্দ্র করে।’
অন্যতম শীর্ষ বৈশ্বিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এইচঅ্যান্ডএমের কান্ট্রি ম্যানেজার জিয়াউর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশ্রমিকদের জন্য বর্তমানে যে মজুরি কাঠামো আছে, সেটা খুবই অন্যায্য। এটাকে একটা সম্মানজনক পর্যায়ে বাড়ানো উচিত।