রাজধানীসংলগ্ন সাভার উপজেলায় সোবহানবাগ হর্টিকালচার সেন্টারের ১৩ দশমিক ২১ একর জমির মধ্যে ৭ দশমিক ৪৯ একর নিয়ে ১১টি মামলা চলছে। আর ২ দশমিক ৬৫ একর জমিতে বসতঘরসহ স্থায়ী স্থাপনা গড়ে তুলেছেন দখলদারেরা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই সেন্টারের আশপাশে প্রতি শতক জমির বাজারমূল্য প্রায় ৩০ লাখ টাকা। সেই হিসাবে ৭ দশমিক ৪৯ একর জমির বাজারমূল্য ২২৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক এম এম এ সালাম বলেন, ‘মামলা চলমান থাকায় জমি নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছি না আদালতের নির্দেশনার কারণে।’
মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সূত্রে জানা গেছে, সাভারের মতো সারা দেশে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন সংস্থার প্রায় ৯৬ একর জমি নিয়ে মামলা চলছে। এসব জমির সিংহভাগই বেদখল হয়ে গেছে।
সূত্রমতে, কোনো কোনো জমির খতিয়ান ও নামজারিও হয়ে গেছে দখলদারদের নামে। এর বিরুদ্ধে এখন আইনি লড়াই চালাচ্ছে সংস্থাগুলো। সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্পত্তি উদ্ধার সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের ৭৪তম সভায় এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন থেকে সংস্থার আইনজীবীর পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের প্যানেল আইনজীবীরাও মামলা পরিচালনায় সহযোগিতা করবেন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, বেদখল হওয়া সম্পত্তির আংশিক তথ্য টাস্কফোর্স সভায় এসেছে। বেদখল হওয়া এসব জমির বাজারমূল্য হাজার কোটি টাকার বেশি।
জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন সংস্থার অনেক জমি বেহাত হয়ে গেছে। অনেকে জোর করে দখলে রেখেছে। এসব বিষয়ে দখলদারদের সঙ্গে মামলা চলমান। কিছু জায়গা আমরা উদ্ধারও করতে পেরেছি। তবে এখনো অনেক জায়গা বেহাত রয়েছে। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় সীমানাপ্রাচীর দিয়ে জমিগুলো নিজেদের দখলে রাখার চেষ্টা করছি।’
টাস্কফোর্স সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সংস্থাগুলোর মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) সবচেয়ে বেশি জমি নিয়ে জটিলতা আছে। এই অধিদপ্তরে প্রায় ৫৪ একর জায়গা নিয়ে মামলা চলছে দখলদারদের সঙ্গে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) প্রায় ৩০ একর, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) ১১ দশমিক ৫০ একর জমি নিয়ে মামলা চলছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরই), বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির জমি নিয়েও জটিলতা আছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্পত্তি উদ্ধারসংক্রান্ত টাস্কফোর্স কমিটির সভাপতি ও অতিরিক্ত সচিব মো. জালাল আহমেদ বলেন, ‘জমির মূল্য অনেক বেশি হওয়ায় দখলদারেরা যেভাবে লেগে থাকতে পারে, সরকারি কর্মকর্তারা সেভাবে পারেন না বদলির কারণে। তা ছাড়া মামলার সংখ্যা অনেক বেশি, কিন্তু জনবল কম। তবে জনবল বাড়ানোর জন্য আমাদের নির্দেশনা আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সম্পত্তি বেদখল যাতে না হয়, সে জন্য চেষ্টা করছি। সভা থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সংস্থার আইনজীবীর পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের প্যানেল আইনজীবীরাও সহযোগিতা করবেন।’
টাস্কফোর্স সভার তথ্যমতে, চট্টগ্রাম জেলার পূর্ব নাসিরাবাদ মৌজায় ডিএইর ৭ দশমিক শূন্য ৪ একর জমি নামজারি আছে জামিল উদ্দিনসহ কয়েকজনের নামে। ভূমি অফিস থেকে বিবাদীকে খাজনা দেওয়ার অনুমতিও দেওয়া হয়েছে। সিলেটে ডিএইর অধিগ্রহণ করা ৩ দশমিক ১৫ একর জমির মধ্যে ২ একর নিয়ে গেছে সরকারি হাসপাতাল। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় কেনা ৪৯ দশমিক ২৩ একর জমির মধ্যে প্রায় ১৫ দশমিক ৯৪ একর ব্যক্তির নামে রেকর্ড হয়েছে। এ নিয়ে মামলা চলছে।
বেদখল হওয়া জমি উদ্ধার করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে ডিএইর মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, অধিকাংশ জায়গা উদ্ধার করতে মামলা চলছে। কিছু জায়গায় এখনো মামলা করা হয়নি। তবে তিনি মনে করেন, ডিএইর জায়গার দখল ধরে রাখতে সীমানাপ্রাচীর বা কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার একটি প্রকল্প দরকার।
জানা গেছে, রাজধানীর মিরপুরে বিএডিসির বীজ উৎপাদন খামারের ২ দশমিক ২৫ একর জমি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) নিয়ন্ত্রণাধীন গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনালের দখলে। এই জমি বিএডিসির অনুকূলে ফেরত দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় সরকার বিভাগে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মিরপুর ও নন্দারবাগ মৌজায় বেদখল ১৫ একর জমির রেকর্ড সংশোধনের জন্য ৯টি মামলা চলছে।
সাতক্ষীরার বিনেরপোতা এলাকায় ব্রির ১১ দশমিক ৫০ একর জমি দখল করে বস্তি বানানো হয়েছে। সেই বস্তিতে ১৩৯টি পরিবারের বসবাস। ব্রির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ‘অনেক বছর ধরে জায়গাটিতে বস্তি, কবরস্থান, মসজিদের মতো স্থাপনা রয়েছে। সাতক্ষীরা শহরের কাছে হওয়ায় জায়গাটির বাজারমূল্যও অনেক বেশি। উদ্ধারের জন্য আমরা চেষ্টা করেছি, তবে এখনো সফল হইনি।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক হামিদুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, জমি নিয়ে জটিলতা নিষ্পত্তি করতে প্রথমে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে যেতে হয়, পরে আসে মামলার বিষয়। দাপ্তরিক কাজের পর অনেক কর্মকর্তা জমিসংক্রান্ত বিষয়গুলো তদারক করতে পারেন না। ফলে জমি বেহাত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।