২২ নভেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ১২:৩২:২৯ পূর্বাহ্ন
রাজশাহী নগরীতে ঘুরেফিরে ভুঁইফোড় সংস্থায় এমপি’র অনুদান
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-১১-২০২৩
রাজশাহী নগরীতে ঘুরেফিরে ভুঁইফোড় সংস্থায় এমপি’র অনুদান

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা বিহাসের ঠিকানায় পরিচালিত দুর্বার মহিলা সংস্থা। জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান এটি। সংস্থার সভানেত্রী মঞ্জুরা বেগম। তবে গিয়ে সংস্থাটির কোন কার্যালয় খুঁজে পাওয়া যায়নি। সংস্থাটি চালান আকলিমা খাতুন নামের এক নারী। তিনি একটি বেসরকারী হাসপাতালের নার্স।যোগাযোগ করা হলে আকলিমা খাতুন জানান, অনেক দিন ধরেই তিনি সংস্থাটি চালান না। কোন অফিসও নেই। অথচ এই সংস্থা গ্রামীন অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির আওতায় প্রায় প্রতি অর্থবছরেই নগদ টাকা বরাদ্দ পায়। রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা ভুঁইফোড় এই সংস্থাটিকে বরাদ্দ দিয়ে আসছেন।


সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৪ হাজার, ২০-২১ অর্থবছরে ৪৫ হাজার এবং ২১-২২ অর্থবছরে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। এই টাকায় কি করা হয়েছে জানতে চাইলে নার্স আকলিমা খাতুন বলেন, ‘আমি এটা বলতে পারব না। রংধনু নামের আরেকটি সংস্থা মনিরা আপা বলতে পারবে।’


রংধনু মহিলা সংস্থাও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৪ হাজার, ২০-২১ অর্থবছরে ৪৫ হাজার এবং ২১-২২ অর্থবছরে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়েছে এমপি বাদশার কাছ থেকে। এর সভানেত্রী মনিরা খাতুন বলেন, ‘আমি আমার সংস্থাটাই চালাই। দুর্বার মহিলা সংস্থার কথা বলতে পারব না।’ মনিরা স্বীকার করেন, তাঁর সংস্থারও কোন অফিস নেই। তিনি বাড়িতেই ‘নারীদের কল্যাণে’ কাজ করেন বলে দাবি করেন। মনিরা বলেন, ‘আমি তো একটা সংস্থা চালাই। অনেকে ২-৩টি করে চালায়। সবগুলোর নামে বরাদ্দ তোলে। তাদের খোঁজ নেন।’


রাজশাহী জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে টিআরের আওতায় এমপি বাদশার প্রকল্প তালিকা নিয়ে দেখা গেছে, ঘুরেফিরে দুর্বার কিংবা রংধনুর মতো ভুঁইফোড় মহিলা সংস্থায় নগদ টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন তিনি। হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া এসব সংস্থার কোন কার্যালয় নেই। কিছু সংস্থা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় এবং সমাজসেবা কার্যালয়ে নিবন্ধিত, কিছু অনিবন্ধিত। অভিযোগ পাওয়া গেছে, যেসব সংস্থা বরাদ্দ পায় তারা জনকল্যাণে কোন কাজই করে না। বরাদ্দের অধিকাংশ টাকাই হরিলুট হয়ে যায়। অপর এক নারী জানিয়েছেন, যারা বরাদ্দ দেন তাদেরই দিতে হয় অর্ধেক টাকা। এই টাকার কারবার থাকার কারণেই নির্দিষ্ট কিছু সংস্থা ঘুরেফিরে অর্থ বরাদ্দ পেয়ে থাকে। ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক বাদশা আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ২০০৮ সাল থেকে এ আসনের এমপি।


তথ্য অধিকার আইনে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০, ২০-২১ ও ২১-২২ অর্থবছরে এমপি ফজলে হোসেন বাদশা মোট ৪ কোটি ৭৬ লাখ ৫৭ হাজার ৪৯৯ টাকা ৯৭ পয়সায় ৭৮৭টি প্রকল্প দিয়েছেন। ১৮৩টি প্রকল্প ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে। আর ১২৬টিই হলো নামসর্বস্ব মহিলা সংস্থা। এসব সংস্থার দু’একটি ছাড়া বাকিগুলোর অফিস তো দূরের কথা; একটি সাইনবোর্ডও নেই। সংস্থাগুলো তিন অর্থবছরে সর্বনিম্ন একবার থেকে ছয়বার পর্যন্ত টাকা পেয়েছে। এক অর্থবছরে একাধিকবার বরাদ্দ দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও অনেক সংস্থাকেই একাধিক বরাদ্দ দিয়েছেন এমপি ফজলে হোসেন বাদশা।


রঙের মেলা মহিলা সংস্থা নামের একটি নামসর্বস্ব সংস্থা তিন অর্থবছরে ৩ লাখ ১৭ হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। প্রতি অর্থবছরেই সংস্থাটিকে দুইবার করে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রথমদফায় ৪৪ হাজার টাকা দেওয়া হয়। একই অর্থবছরের দ্বিতীয়দফায় একটি মাদ্রাসা ও একটি মসজিদের বরাদ্দ বাদ দিয়ে এ সংস্থাটিকে ৮৮ হাজার টাকা দিতে জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি দেন এমপি বাদশা। এই সংস্থাটিরও কোন কার্যক্রম কখনও দেখা যায়নি নগরীতে।


তিন অর্থবছরে পাঁচবার করে অর্থ বরাদ্দ পেয়েছে দুস্থ মহিলা সমাজকল্যাণ সমিতি, পথশিশুদের শিক্ষা নিকেতন, ইচ্ছামতি, উৎসব, গোধুলি, জোনাকী, মেঘালয়, সন্ধ্যাতারা ও সবুজ মহিলা কল্যাণ সমিতি। চারবার করে অর্থ পেয়েছে দুস্থ ও বেকার মহিলা কল্যাণ সমিতি, আলোকিত নারী, করতোয়া, গন্ধরাজ, ডালিয়া, মধুমতি, শতদল ও সোনামনি মহিলা কল্যাণ সংস্থা এবং ষষ্ঠীতলা মহিলা উন্নয়ন সংস্থা। নিয়ম ভেঙে ষষ্ঠীতলা মহিলা উন্নয়ন সংস্থাটিকে দুই অর্থবছরেই চারদফায় ২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এমপি বাদশার দেওয়া তালিকায় এই সংস্থার নাম বাদ পড়েছিল। পরে রাজশাহী পুলিশ লাইনের শহীদ মিনার সংস্কারে দেওয়া এক লাখ টাকার আগের প্রকল্প বাতিল করে সেই টাকা এই সংস্থাটিকে টাকা দিতে জেলা প্রশাসককে চিঠি দেন এমপি বাদশা।

তিনি তিন অর্থবছরে তিনবার করে টাকা দিয়েছেন হস্তশিল্প উন্নয়ন সংস্থা, প্রাথমিক ক্রীড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মাদল সাংস্কৃতিক সংস্থা, আদিবাসী নারী কল্যাণ সংস্থা, অনন্যা, এসো করি, কৃষ্ণচ‚ড়াফুল, দুর্বার, রংধনু, মীম, সাগরিকা, সুদর্শন, স্নেহের আঁচল ও হেতেমখাঁ লিচুবাগান মহিলা সংস্থাকে। দুইবার করে অর্থ বরাদ্দ পেয়েছে আরও ২৮টি নামসর্বস্ব মহিলা সংস্থা। এসব সংস্থার কারও কোন কার্যক্রম চোখে পড়ে না। এদের কোন অফিসও খুঁজে পাওয়া যায়নি।


দলীয় নেতাকর্মীদেরও দেওয়া হয়েছে প্রকল্প:

এমপি ফজলে হোসেন বাদশা প্রতি অর্থবছরেই তাঁর নিজ দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বরাদ্দ দিয়ে থাকেন। নামসর্বস্ব সংস্থা ও সংগঠন দেখিয়ে নেতাকর্মীরা বরাদ্দ নেন। এরমধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির সহযোগী সংগঠন নারী মুক্তি সংসদকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ লাখ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন তিনি। শিবিরের হাতে নিহত পার্টির ছাত্রসংগঠন ছাত্রমৈত্রীর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ শাখার সভাপতি জামিল আক্তার রতনের স্মৃতি সংসদে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। শহীদ জামিল আক্তার রতন ফাউন্ডেশন নামের আরেক সংগঠনে দেওয়া হয়েছে ৩ লাখ। শহীদ জামিল ব্রিগেড নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কোন অফিস না থাকলেও কম্পিউটার কেনা বাবদ বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ২ লাখ টাকা। শহীদ জামিল আক্তার রতন স্মৃতি সংসদকে একবার ৮৮ হাজার টাকা দিতে একটি স্কুল ও একটি মাদ্রাসার নাম কেটে দেওয়া হয়। একটি ভুঁইফোড় মহিলা সংস্থাকে টাকা দিতে আগে দেওয়া রাজশাহী পুলিশ লাইনের শহীদ মিনার সংস্কারের প্রকল্প বাতিল করেন এমপি বাদশা।


অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেশকিছু সংগঠনের নামে টাকা নেন ওয়ার্কার্স পার্টির মহানগরের সাধারণ সম্পাদক দেবাশিষ প্রামানিক দেবু। কখনও নিজে, কখনও অন্য কাউকে প্রকল্প সভাপতি করে আদিবাসী উন্নয়ন কেন্দ্র, আসাউস, আস্থা নেটওয়ার্ক, অভিযাত্রী ক্লাব, আদিবাসী নারী-শিশু পাচার প্রতিরোধ সংস্থা, আলপনা সংগীত বিদ্যালয়, আস্থা সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা, গণশিল্পী সংস্থা, আদিবাসী নারী কল্যাণ সংস্থাসহ বেশকিছু সংস্থার নামে টাকা তোলেন তিনি। প্রায় প্রতিটি বরাদ্দের তালিকায় এসব সংস্থার নাম থাকে। আস্থা নেটওয়ার্ক তিন অর্থবছরে ৩ লাখ ৪৫ হাজার, আদিবাসী নারী কল্যাণ সংস্থা ১ লাখ ৯৫ হাজার ও আসাউস সাড়ে ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। অন্য সংস্থাগুলো পেয়েছে ৪৪ হাজার ৫০০ থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত। দেবু এসব বিষয় নিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান।


ছাত্রমৈত্রীর রাজশাহী মহানগরের সভাপতি ওহিদুর রহমানও পথশিশুদের শিক্ষা নিকেতন নামে একটি সংগঠনের নামে বার বার টাকা তোলেন। শহরে এই সংগঠনের কোন কার্যক্রম কখনও দেখা যায়নি। অথচ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ লাখ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯৫ হাজার ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়েছে সংগঠনটি। তিন অর্থবছরে মোট ছয়বার অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে ওহি দাবি করেছেন, তিনি টাকা তুলেছেন দুইবার।


এসব বরাদ্দের বিষয়ে এমপি বাদশা সাংবাদিকদের বলেন, ‘ওরা চায়, তাই দিতে হয়।’ বিভিন্ন ভুঁইফোড় সংস্থায় বরাদ্দের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেশে এত বড় বড় দুর্নীতি হচ্ছে, এসব বাদ দিয়ে এই সংস্থাগুলোর ব্যাপারে কেন খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।’ বাদশা দাবি করেন, স্বচ্ছতার সঙ্গে তার প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি। সব টাকা হরিলুট হয়ে যায় এ অভিযোগ সত্য নয়।


জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সালাহ উদ্দীন আল ওয়াদুদ বলেন, ‘জনবল সংকটের কারণে সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। তবে আমরা চেষ্টা করি যেন নিবন্ধিত ভাল সংগঠন-সংস্থাগুলোই টাকা পায়। অনিয়মের অভিযোগ যেহেতু সামনে এসেছে, তাই এবার থেকে প্রকল্প অনুমোদনের সময় আমরা সতর্ক থাকব।’ তাদের কার্যালয় ও সংগঠনের নামে বরাদ্দ নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা যে বরাদ্দ নিয়েছে তার সবগুলোরই কাজ হয়েছে।’


শেয়ার করুন