২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৬:০৯:০০ অপরাহ্ন
অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে মাতারবাড়ীর বিদ্যুৎ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০১-০১-২০২৪
অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে মাতারবাড়ীর বিদ্যুৎ

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসাবে সারাবিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। একের পর এক মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, যোগাযোগ, ব্যবসাবাণিজ্য ও নাগরিক সুবিধার ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমান সরকারের ১০টি বৃহৎ প্রকল্পের সুফল নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক প্রতিবেদন-


দেব দুলাল মিত্র : মানসম্পন্ন, নির্ভরযোগ্য ও জ্বালানি সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই একের পর এক প্রকল্প নিয়ে আসছে। এরই অংশ হিসেবে কয়েকটি মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এর মধ্যে মাতারবাড়ী ‘আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল-ফায়ার্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট’ অন্যতম। শেখ হাসিনার ‘ফার্স্ট ট্র্যাক’ প্রকল্প হিসেবে এই প্রকল্পটি চিহ্নিত। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী দেশ জাপানের সহযোগিতায় এই বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে। আগামী বছর দুই ইউনিট বিশিষ্ট ও ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। জ্বালানি সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া পরিকল্পনা কমিশনের টার্গেট অনুযায়ী অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে- তা এই মেগা প্রকল্পটির মাধ্যমে অর্জিত হবে। চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত এই প্রকল্পের প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে।

কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী এলাকায় আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল-ফায়ার্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। কয়লাভিত্তিক


এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি মাতারবাড়ী ও ধলঘাট ইউনিয়নের ১ হাজার ৪১৪ একর জমিতে এই প্রকল্পটি নির্মিত হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ‘কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল)’। বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতিটি ইউনিট থেকে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। চুক্তি অনুযায়ী চলতি বছরের মধ্যে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের উৎপাদনে আসার কথা ছিল কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় এখনই তা সম্ভব হচ্ছে না। একনেকে প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে প্রথম সংশোধনের মাধ্যমে এই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করেই এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে।

শুধু ভূমি অধিগ্রহণ ও নির্মাণকাজের মধ্যে এই প্রকল্পটির সার্বিক কাজ সীমাবদ্ধ থাকেনি। ভূমি অধিগ্রহণের পাশাপাশি এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ৩৫০ মিটার প্রস্থ ও ১৮ দশমিক ৫ মিটার গভীরতার একটি চ্যানেলের নাব্য ফেরানো, কয়লাবাহী জাহাজ নোঙর করার জন্য নিজস্ব জেটি, কোল ইয়ার্ড ও চিমনি নির্মাণ, সি-ওয়াল রেভেটমেন্ট এবং সেডিমেন্ট মিটিগেশনসহ আনুষাঙ্গিক ফ্যাসিলিটিস নির্মাণ, পাওয়ার প্ল্যান্ট এরিয়া ও টাউনশিপের জন্য ভূমি উন্নয়ন, পাওয়ার প্ল্যান্ট ও আনুষাঙ্গিক ফ্যাসিলিটিজ নির্মাণ, পল্লী বিদ্যুতায়নের আওতায় ২৫/৪১ এমভিএ ক্ষমতার ১৩২/৩৩ কেভি সঞ্চালন উপকেন্দ্র, ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন, ১০ এমভিএ ক্ষমতার ৩৩/১১ কেভি বিতরণ উপকেন্দ্র নির্মাণ, পুরো প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ দেয়া এবং টাউনশিপ নির্মাণকাজও রয়েছে।

বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, মূলত চারটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল-ফায়ার্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে- ২০২৪ সালের মধ্যে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো, মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর উন্নয়নে সহায়তা করা, মানসম্পন্ন ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করা এবং জ্বালানি সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে মানসম্পন্ন, নির্ভরযোগ্য ও জ্বালানি সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নেও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রকল্পের নির্মাণকাজের ৭৮ দশমিক ৩০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। জাপান সরকারের ৪৪তম ওডিএ লোন প্যাকেজের দ্বিতীয় ব্যাচের আওতাধীন মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল-ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্টের সপ্তম পর্যায়ে ঋণের জন্য বাংলাদেশ এবং জাপান সরকারের মধ্যে কিছুদিন আগে বিনিময় নোট ও ঋণচুক্তি হয়েছে।

স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত জাপান সরকার বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বিভিন্ন সেক্টরে উল্লেখযোগ্য সহায়তা দিয়েছে। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে জিওবি অর্থাৎ সরকারি তহবিল থেকে দেয়া হবে ৬ হাজার ৪০৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা, জাইকা দেবে ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি ৩ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিপিজিসিবিএল দেবে ১ হাজার ৫২৭ কোটি ৬৯ লাখ কোটি টাকা। জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা সিংহভাগ অর্থের জোগান দিচ্ছে। তবে প্রকল্পের মূল অনুমোদিত ব্যয় প্রথমে ছিল ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, একটি টেকসই স্থাপনা নির্মাণ এবং এজন্য আনুষাঙ্গিক বিভিন্ন কারণে ব্যয় ও প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় বেড়েছে। এর মধ্যে চ্যানেল, জেটি, ভূমি উন্নয়ন এবং পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণসহ অন্যান্য সিভিল ওয়ার্কস খাত, ভ্যাট-আইটি ও আমদানি শুল্ক খাত, পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ কার্যক্রম খাত, পল্লী বিদ্যুতায়ন ও টাউনশিপ নির্মাণ খাতে ব্যয় বেড়েছে। আইডিসি ও কন্টিনজেনসি খাতে ব্যয় কমেছে। এছাড়া পরামর্শক সেবা খাতে পরিমাণ ও ব্যয় বেড়ে যাওয়া এবং ডিটেইল ডিজাইন অনুযায়ী কাজের পরিধি বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ও ব্যয় বেড়েছে।

ভূতত্ত্ববিদ ও জ¦ালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, দীর্ঘমেয়াদি জ¦ালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা অনেক দেরি করে ফিলেছি। বৈশ্বিক জ¦ালানি সংকট সামনে আসার পর আমাদের দূর্বলতাগুলো প্রকাশ পেয়েছে। এখন দীর্ঘমেয়াদি জ¦ালানি নিরাপত্তায় সরকারকে জোরালো কৌশল নিয়ে কাজ করতে হবে। সরকার এখন যেভাবে কাজ করছে এগুলো আরো ১০ বছর আগে নিলে আজ আমাদের বিদ্যুৎ সংকট থাকত না। তখন গ্যাসের উৎপাদন বাড়লে বিদ্যুতের উৎপাদনে এখন ঘাটতি থাকত না। মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্ল্যান্টসহ যেসব বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে; সেগুলো উৎপাদনে এলে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি জ¦ালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি আমদানিনির্ভর না হয়ে স্থানীয় উৎসগুলোর ওপর নির্ভরতা বাড়তে হবে। আমাদের গ্যাস আছে, কয়লা আছে, সম্প্রতি তেল পাওয়া গেছে- এগুলোর ব্যবহারও করতে হবে। দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে জাপান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী দেশ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে জাপান সরকারের সহযোগিতা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে জোরালো ভূমিকা রাখবে।


শেয়ার করুন