তৈরি পোশাকসহ সব কারখানার মালিক-শ্রমিক বিরোধ মীমাংসা, শ্রমিকের বকেয়া এবং পাওনা আদায়ের মধ্যস্থতার ক্ষমতা চায় শিল্প পুলিশ। এই ক্ষমতা নিতে শ্রম আইনের পাঁচটি ধারা সংশোধনেরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আইনে কারখানা বন্ধ এবং শ্রমিক ছাঁটাইয়ের সাত দিন আগে পুলিশকে জানানোর বিধান অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাবও রয়েছে।
শিল্প পুলিশ সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে ওই প্রস্তাব দিয়ে বলেছে, এটি বাস্তবায়িত হলে শ্রমিক অসন্তোষ কমবে। শিল্পাঞ্চলে স্থিতিশীলতা বিরাজ করবে। বিষয়টি আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে।
শ্রমিকনেতারা শিল্প পুলিশের প্রস্তাবের বিরোধিতা করছেন। তাঁরা বলছেন, অর্থের স্বার্থ থাকায় পুলিশ হয়তো এ খাতে অন্তর্ভুক্ত হতে চায়। শ্রম আইনে পুলিশের অন্তর্ভুক্তি শ্রমিক নির্যাতন বাড়াবে। শ্রমিকের সংগঠন করার অধিকার, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার খর্ব হবে। তাঁরা শ্রম আইনে পুলিশের অন্তর্ভুক্তি নয়, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ক্ষমতা বাড়ানোর পক্ষে।
পোশাক কারখানার মালিকেরা বলছেন, এটি বেআইনি প্রস্তাব। পুলিশের কাজ শ্রমিক ও কারখানার নিরাপত্তা দেওয়া। তবে কারখানা বন্ধ এবং শ্রমিক ছাঁটাইয়ের বিষয়ে পুলিশকে আগে জানানোর প্রস্তাবটি কোনো কোনো মালিক সমর্থন করছেন।
সূত্র জানায়, শ্রম আইনের পাঁচটি ধারা সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মো. সাইফুল হক স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে। এতে শ্রম আইনের ১২, ১৩, ১৩(১), ২০ ও ১২৪(ক) ধারা সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। শ্রম আইনের ১২৪(ক) ধারা অনুযায়ী, মালিক ও শ্রমিকেরা আপস-মীমাংসার জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শকের কাছে আবেদন করলে সংস্থাটি দুই পক্ষকে নিয়ে বসে বিভেদ দূর করতে ভূমিকা রাখে। এই ধারা সংশোধন করে মীমাংসাকারীর ভূমিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে চায় শিল্প পুলিশ।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কর্মরত বা অবসর নেওয়া বা চাকরি অবসান বা বরখাস্ত থাকাসহ চাকরির যেকোনো পর্যায়ে শ্রমিকের মজুরিসহ আইনগত প্রাপ্য পাওনা আপস-মীমাংসার মাধ্যমে পেতে মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বা মহাপরিদর্শকের ক্ষমতাপ্রাপ্ত বা শিল্প পুলিশের প্রধান (অতিরিক্ত আইজিপি) বা সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপার বা মেট্রোপলিটন পুলিশপ্রধানের কাছে আবেদন করা যাবে। আবেদন পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা সর্বোচ্চ ২০ দিনের মধ্যে কারখানার মালিক বা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসে নিষ্পত্তির কার্যক্রম নেবেন। এই প্রস্তাবের পক্ষে শিল্প পুলিশের যুক্তি, শিল্পসংক্রান্ত সব বিরোধ মীমাংসায় শিল্প পুলিশ মুখ্য ভূমিকা রাখে। মালিক-শ্রমিক নেতৃবৃন্দ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে শিল্প পুলিশের বৈঠক ও কার্যক্রমের কারণে বেতন-ভাতাসহ সব ধরনের বিরোধ দ্রুত ও সহজে নিষ্পত্তি হয়। তাই ভূমিকাকে আইনগত ভিত্তি দিলে শিল্প পুলিশের কার্যক্রম আরও জোরদার হবে। শিল্পাঞ্চলে নিরাপদ পরিবেশ থাকবে।
শিল্প পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. মাহবুবুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা সব সময় এই কাজটি অনানুষ্ঠানিক করি। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও মালিক-শ্রমিকদের নিয়ে বসে সমস্যার সমাধান করি। সে জন্য আমরা একটি প্রস্তাব দিয়েছি। শ্রম আইনে পুলিশকে আপস-মীমাংসার ক্ষমতা দিলে আরও ভালো হবে। এখনো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। আলোচনায় রয়েছে।’
এ ছাড়া কারখানা দু-এক দিন বন্ধ, সাময়িক বন্ধ, একেবারে বন্ধ রাখার এবং শ্রমিক ছাঁটাইয়ের বিষয় সাত দিন আগেই শিল্প পুলিশ, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে জেলা পুলিশ বা মেট্রোপলিটন পুলিশকে জানানো মালিকের জন্য বাধ্যতামূলক করতে শ্রম আইনের ১২, ১৩, ১৩(১) ও ২০ ধারা সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর পক্ষে শিল্প পুলিশের যুক্তি, দ্রুত খবর পেলে যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা প্রতিহত করা এবং শিল্পকারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হবে।
শিল্প পুলিশের প্রধান বলেন, কোনো কারখানা হঠাৎ বন্ধ করলে বা শ্রমিক ছাঁটাই করলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। নাশকতা ঘটে। তা তাৎক্ষণিক সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। পুলিশ বিষয়টি আগে থেকে জানতে পারলে প্রস্তুতি নিতে পারবে। আলোচনা করেও সমস্যার সমাধান করা যায়। এ জন্যই আগে জানানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
শিল্প পুলিশের এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করছেন পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা। গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এটি একটি ষড়যন্ত্র। পুলিশ এই ক্ষমতা পেলে শ্রমিকেরা সংগঠন করার অধিকার, রাজনৈতিক ও ন্যায্য পাওনার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। আমরা কখনো পুলিশকে এই ভূমিকায় দেখতে চাই না।’
গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার বলেন, পুলিশের কাজ শ্রমিকের বকেয়া আদায় করা নয়। এ কাজের জন্য সরকারের আলাদা প্রতিষ্ঠান ও প্রতিনিধি আছে, শ্রমিক ও মালিকদের সংগঠন আছে, ট্রেড ইউনিয়ন আছে। পুলিশ এসব কাজ করতে গেলে শ্রমিক হয়রানি বাড়বে। পুলিশের উচিত শ্রমিক ও কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, এখানে অর্থের স্বার্থ রয়েছে। তাই হয়তো পুলিশ এই খাতে ঢুকতে চায়। এ ছাড়া শ্রমিকেরা যাতে তাঁদের অধিকারের কথা না বলতে পারেন, সে জন্য নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। তবে তা হতে দেওয়া হবে না।
শিল্প পুলিশের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন বাড়বে বলে মন্তব্য করেন গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক সাদেকুল ইসলাম শামীম। তিনি বলেন, এর চেয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শকদের আইনে আরও ক্ষমতা দিলে তাঁরাই কাজটি ভালো করতে পারবেন।
বিরোধ মীমাংসায় পুলিশকে ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাবের বিরোধী পোশাক কারখানার মালিকেরাও। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, এটি একটি বেআইনি প্রস্তাব। শ্রমিকের বকেয়া থাকলে প্রথমে তিনি মালিকের কাছে যাবেন। প্রতিকার না পেলে মালিকদের সংগঠনে যাবেন, তা-ও পাওনা না পেলে শ্রম অধিদপ্তর অথবা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে যাবেন। প্রয়োজনে শ্রম আদালতে যাবেন। পুলিশের তো এখানে কোনো কাজ নেই।পুলিশের কাজ শ্রমিক ও কারখানার নিরাপত্তা দেওয়া।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি মো. শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, আপস-মীমাংসার জন্য মালিক, শ্রমিক ও সরকারের প্রতিনিধিদল রয়েছে। এ কাজে অন্য কেউ আসতে চাইলে আলোচনা করে আসতে হবে। তবে কারখানা বন্ধ এবং ছাঁটাইয়ের বিষয়ে পুলিশকে আগে জানানোর বিষয়টি করা যেতে পারে। এতে কারখানা ও শিল্পের ক্ষয়ক্ষতি কমবে।