২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০৭:৫৪:৪৬ অপরাহ্ন
শিল্প খাতের সামনে যতসব চ্যালেঞ্জ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১০-০৩-২০২৪
শিল্প খাতের সামনে যতসব চ্যালেঞ্জ

মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানোর কৌশল নিয়েছে। ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সব ধরনের ঋণের সুদহার লাগামহীন গতিতে বাড়ছে। 


গত সাত মাসের ব্যবধানে আমদানি ও বাণিজ্যিক ঋণের সুদহার ৪ এবং শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণের সুদ ৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে। 


রপ্তানিতে প্রাক-জাহাজীকরণ খাতে ঋণের সুদ ৮ শতাংশের বেশি, ইডিএফ সুদ দ্বিগুণের বেশি, কৃষি ঋণের সুদ ৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে। একই সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঋণের সুদ ৬-৭ শতাংশের বেশি বেড়েছে। 


সুদের হার মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধিতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের খরচ বেড়েছে। একই সঙ্গে বাড়ছে পণ্যের দাম। এতে একদিকে যেমন রপ্তানির বাজারে দেশের পণ্য তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছে। তেমনি দেশের বাজারে এ প্রতিযোগিতা আরও কঠিন হয়েছে। 


এছাড়া পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক মন্দায় ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। ফলে নিট বিক্রি হ্রাস পেয়েছে। এতে শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নগদ টাকার প্রবাহ কমেছে। 


একদিকে বেসরকারি খাত থেকে সরকারকে দেওয়া রাজস্বের জোগান কমেছে, অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের কাছে টাকার প্রবাহ কমেছে। ব্যাংক ঋণ পরিশোধেও উদ্যোক্তারা চাপে পড়েছেন। 


উদ্যোক্তাদের প্রবল দাবির মুখে ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে বেঁধে দেওয়া হয়। ওই সময়ে রপ্তানি ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৭ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়। 


ওই সময়ে কৃষি ঋণ ও শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণের সুদহার ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এরপর থেকে গত ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ওই হারেই ঋণ পাওয়া যেত। তবে ভোক্তাঋণসহ কিছু খাতে ঋণের সুদহার ২০২৩ সাল থেকেই বাড়ছিল। 


আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সীমা তুলে দিতে বাধ্য হয়। ফলে গত ১ জুলাই থেকে ঋণের ঊর্ধ্বসীমা ৯ শতাংশ প্রত্যাহার করে নেয়। 

একই সঙ্গে সুদহার বাজারভিত্তিক করার জন্য একটি করিডোর বা ভিত্তি সুদ আরোপ করে। এর মাধ্যমে সরকারের ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদের হারের  সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত একটি অংশ যোগ করে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হবে। 


গত জুলাই থেকে এ পদ্ধতিতে সুদ নির্ধারিত হচ্ছে। ওই সময় থেকেই এ হার বাড়ছে। এর মধ্যে আইএমএফ মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি ব্যবহার করার চাপ দেয়। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদ হার বাড়াতে নীতি সুদ হারসহ সব ধরনের সুদ হার বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়। 


একই সঙ্গে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণের মাধ্যমে বাজারে টাকার প্রবাহ কমানোর নীতি গ্রহণ করে। গত টানা দুই বছর ধরে এ নীতি চলছে। এতে বাজারে টাকার প্রবাহ কমেছে, বেড়েছে সুদহার। 


গত বছরের সেপ্টেম্বরে সরকারের ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদ হার ছিল ৭ দশমিক ২০ শতাংশ। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ। ওই সময়ে এর সুদহার বেড়েছে ২ দশমিক ৪১ শতাংশ। 


একই সময়ের ব্যবধানে এর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত ভিত্তিসুদ যোগ করার হারও বেড়েছে। গত জুলাইয়ে সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে ট্রেজারি বিলের গড় সুদের সঙ্গে সাধারণ ঋণে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ ও কৃষি ঋণে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ যোগ করে সুদ হার নির্ধারণের শর্ত ছিল। 


এখন তা বাড়িয়ে কৃষি খাতে আড়াই ও সাধারণ ঋণে সাড়ে ৩ শতাংশ যোগ করে সুদহার নির্ধারণের শর্ত রয়েছে। এ হার গত ডিসেম্বরে বাড়িয়ে সাধারণ ঋণে পৌনে ৪ শতাংশ ও কৃষি ঋণে পৌনে ৩ শতাংশ যোগ করার শর্ত ছিল। ফেব্রুয়ারিতে ট্রেজারি বিলের সুদ হার বেশি মাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত ভিত্তিসুদ  দশমিক ২৫ শতাংশ কমিয়েছে। 


নতুন পদ্ধতিতে সাধারণ ঋণের সুদহার বেড়ে দাঁড়িয়েছে সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ। গত জুলাইয়ের আগের এ হার ছিল ৯ শতাংশ। এ খাতে সুদ হার বেড়েছে ৪ দশমিক ১১ শতাংশ। একই সময়ের ব্যবধানে শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণের সুদহার ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ। এ খাতে সুদহার বেড়েছে ৫ দশমিক ১১ শতাংশ। 


ব্যবসা-বাণিজ্য ও আমদানি খাতে গত জুন পর্যন্ত সুদ ছিল ৯ শতাংশ। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ। ওই সাত মাসে এ খাতে সুদহার বেড়েছে ৪ দশমিক ১১ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে রপ্তানি খাতে প্রাক জাহাজীকরণ ঋণের সুদহার। 


রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) বিকল্প হিসাবে ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি রপ্তানি সহায়ক প্রাক জাহাজীকরণ অর্থায়ন করতে ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে। এ তহবিল থেকে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়ার হতো। কয়েক দফায় এর সুদহার বাড়িয়ে এখন করা হয়েছে ১২ দশমিক ১১ শতাংশ। এ খাতে সুদহার বেড়েছে তিনগুণের বেশি অর্থাৎ ৮ দশমিক ১১ শতাংশ। 


রপ্তানি খাতে আগে বৈদেশিক মুদ্রায় ইডিএফ থেকে ২ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হতো। ওই অর্থ রিজার্ভে নিয়ে আসায় এর আকার ছোট করা হয়। একই সঙ্গে সুদ বাড়িয়ে এখন সাড়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। এ খাতে সুদ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি অর্থাৎ আড়াই শতাংশ। 


এ প্রসঙ্গে উদ্যোক্তারা বলেছেন, দেশের রপ্তানি খাত এমনিতেই তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে। বৈশ্বিক মন্দায় রপ্তানির আদেশ কমছে। সুদ হার বাড়ার কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এতে বিদেশের বাজারে প্রতিযোগিতা আরও বেড়েছে। 


এছাড়া ব্যবসা বাণিজ্যের খরচ বাড়ার ক্ষেত্রে ডলার অন্যতম একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। ডলারের দাম বাড়ায় খরচ যেমন বেড়েছে, তেমনি ডলারের সংকটেও ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। 


বিশেষ করে আমদানিনির্ভর শিল্প এখন খুবই সংকটে। এর মধ্যে সুদহার বাড়ায় এ খাতের খরচ আরও বেড়ে যাচ্ছে। গত পৌনে দুই বছরের ব্যবধানে ডলারের দাম বেড়েছে ২৮ থেকে ৪৮ শতাংশ। এতে ব্যবসার খরচও বেড়েছে। 


বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে ডলারের দাম বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম ও দেশের বাজারেও পণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি। সুদহার বৃদ্ধির কারণে এ খাতে চাপ আরও বাড়বে। ফলে মূল্যস্ফীতিতে চাপ থাকবে। 


অর্থনীতিতে বড় জোগান আসে কৃষি খাত থেকে। এ খাতে ঋণের সুদহার আগে ছিল ৮ শতাংশ। গত সাত মাসের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ১১ শতাংশে। আলোচ্য সময়ে এর সুদ বেড়েছে ৪ দশমিক ১১ শতাংশ। 


শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য সহায়ক হিসাবে ভোক্তা ঋণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ ঋণের ভোক্তারা শিল্প পণ্যগুলো ক্রয় করেন। এ খাতে সুদহার বাড়ায় ঋণ কমবে। ফলে পণ্যের বিক্রিও কমবে। আগে ভোক্তা ঋণের সুদ ছিল ৯ শতাংশ। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ। এ খাতে সুদ বেড়েছে ৫ দশমিক ১১ শতাংশ। 


ব্যাংকের পাশাপাশি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঋণ সুদহার বেড়েছে। এ খাতে গত জুনে সাধারণ ঋণের সুদ ছিল ৯ শতাংশ। এখন তা বেড়ে ১৫ দশমিক ১১ শতাংশে উঠেছে। ওই সময়ে সুদ বেড়েছে ৬ দশমিক ১১ শতাংশ। এ খাত থেকে ভোক্তা ঋণের সুদহার একই সময়ে ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৬ দশমিক ১১ শতাংশ হয়েছে। সুদ বেড়েছে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। 


সূত্র জানায়, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ওই হারে আনুষ্ঠানিক সুদ নেওয়া হয়। এর বাইরে সুদের সঙ্গে বিভিন্ন ধনর ফি বা কমিশনও নেওয়া হচ্ছে। এতে সুদ হার আরও বেড়ে যাচ্ছে। 


উদ্যোক্তারা বলেছেন, মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণের দোহাই দিয়ে এমন সময় সুদ বাড়ানো হচ্ছে যখন দেশের অর্থনীতি মন্দায় আক্রান্ত। বৈশ্বিক মন্দার ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই সুদহারের এ ধরনের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে, যা দেশ-বিদেশের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যকে আরও প্রতিযোগিতার মুখে ফেলে দিচ্ছে।


এদিকে করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার কারণে ঋণের কিস্তি পরিশোধে ছাড়ের সুযোগ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল। এরপর থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। ডলার ও সুদের কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ায় বিক্রি কমে গেছে। এতে উদ্যোক্তাদের কাছে টাকার প্রবাহও কম। ফলে অনেকেই ঋণের কিস্তি পরিশোধে সমস্যায় পড়ছেন। 


এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, সুদহার নিরূপণের বর্তমান পদ্ধতিতে এ হার বেশি মাত্রায় বাড়ার শংকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে ভিত্তি সুদ দশমিক ২৫ শতাংশ কমিয়েছে। ট্রেজারি বিলের সুদ যাতে আর না বাড়ে সেদিকে দৃষ্টি রাখা হয়েছে। 


বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদহার বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ছোট ব্যাংকগুলোতে এ হার বেড়ে ১২ শতাংশে উঠেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এ হার ১২ দশমিক ১১ শতাংশ। আমানতের সুদ বাড়লে ঋণের সুদহারও বাড়বে।


শেয়ার করুন