সমুদ্রে চলাচলকারী সব নৌযানে অটোমেটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম (এআইএস) নামে একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এতে একটি ছোট ডিভাইসের মাধ্যমে ৫০ নটিক্যাল মাইল দূরত্বের মধ্যে থাকা সব নৌযানের নাম, অবস্থান, গন্তব্য, গতি ইত্যাদি তথ্য জানা যায়। মূলত, এক জাহাজের সঙ্গে অন্য জাহাজের সংঘর্ষ এড়াতে জাহাজে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
সোমালিয়ার জলদস্যুরা ওই ডিভাইসের মাধ্যমে বাংলাদেশি জাহাজ এম ভি আব্দুল্লাহকে টার্গেট করে বলে ধারণা করছেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী।
তিনি বলেন, দেড় মাসে আগে একটি ইরানি মাছধরা নৌযান জব্দ করেছিল সোমালিয়ার জলদস্যুরা। ওই ইরানি ফিশিং বোটে থাকা এআইএস প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েই এম ভি আবদুল্লাহ’র গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তথ্য পেতে পারে জলদস্যুরা।
জলদস্যুরা কেন বাংলাদেশি জাহাজকে বেছে নিল— এ প্রসঙ্গে ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, ‘ওদের টার্গেট সিলেকশন দুর্বল জাহাজের ওপর। যে জাহাজটা দুর্বল সেটাকেই ওরা ধরে। ওই জাহাজটির গতি কম ছিল, পানি থেকে ডেকের দূরত্ব কম, এসব ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই দস্যুরা অগ্রসর হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আরও অনেক জাহাজ ওই রুটে চলছিল। সেগুলোকে সেফগার্ড দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, মূলত সশস্ত্র রক্ষীরা থাকে। যা এই জাহাজে ছিল না। সাধারণত উপকূলের কাছাকাছি ঘটনাগুলো ঘটে। সে হিসেবে এটা রিস্ক জোনের বাইরে ছিল।’
কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, জাহাজটি দস্যুদের নিয়ন্ত্রণে সোমালিয়ার উপকূলে নোঙর করা হয়েছে বলে আমরা জেনেছি। এখন পর্যন্ত দস্যুদের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। নাবিকরা নিরাপদে আছেন। তাদের মুক্ত করার ব্যাপারে কাজ করছি আমরা।’
অপহরণের শিকার হওয়া চট্টগ্রামের জাহাজটিকে সোমালিয়া উপকূলে নোঙর করানোর পরপরই জাহাজে থাকা জলদস্যুদের দলে এসেছে পরিবর্তন।
বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) দুপুরে সোমালিয়ার গারাকাদ উপকূলের হোবিও বন্দরে যাওয়ার পর জলদস্যুদের নতুন একটি দল এমভি আবদুল্লাহ’র নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। রাত ৮টায় সোমালিয়ার স্থলভাগ থেকে মাত্র সাত নটিক্যাল মাইল দূরে শনাক্ত করা গেছে জাহাজটিকে।
ব্রিটিশ মেরিটাইম সিকিউরিটি কোম্পানি জানিয়েছে, জাহাজটিতে বর্তমানে ২০ জন সশস্ত্র সোমালীয় জলদস্যু রয়েছে। জলদস্যুদের আগের পুরো দলটি জাহাজ ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। হালকা অস্ত্র বহনকারী ওই দলে কমপক্ষে ৫০ জন সদস্য ছিল। এদিকে প্রায় ৪০ ঘণ্টা পর আবার নাবিকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে জাহাজ মালিকপক্ষ।
জলদস্যুদের নতুন দলটিতে অন্তত ২০ জন অস্ত্রধারী রয়েছে। তাদের সবার হাতে রয়েছে ভারী অস্ত্র। জলদস্যুদের নতুন দলটি নাবিকদের নিজ নিজ কক্ষে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। এর আগের দলটি সব নাবিককে এক কক্ষে জিম্মি করে রেখেছিল।
এর আগে বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার (১২ মার্চ) দুপুরে শিল্প গ্রুপ কেএসআরএমের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজটি জিম্মি করে সোমালিয়ান দস্যুরা। সেখানে থাকা ২৩ নাবিককে একটি কেবিনে আটকে রাখা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় জাহাজের ইন্টারনেট সংযোগও। ছিনিয়ে নেওয়া হয় নাবিকদের কাছে থাকা মোবাইল, সঙ্গে থাকা ডলার।
জাহাজটি ৫৮ হাজার টন কয়লা নিয়ে ৪ মার্চ আফ্রিকার মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে। ১৯ মার্চ সেটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের হামরিয়াহ বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। নাবিক ও ক্রুসহ জাহাজটিতে ২৩ জন বাংলাদেশি রয়েছেন। মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে জাহাজটিকে ভারত মহাসাগর থেকে সোমালিয়ার উপকূলে নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরু করে জলদস্যুরা। জাহাজটি ওই সময় সোমালিয়া উপকূল থেকে ৪৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছিল।
কবির গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন ‘এমভি আবদুল্লাহ’ আগে ‘গোল্ডেন হক’ নামে পরিচিত ছিল। ২০১৬ সালে তৈরি বাল্ক কেরিয়ারটির দৈর্ঘ্য ১৮৯ দশমিক ৯৩ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ দশমিক ২৬ মিটার। গত বছর জাহাজটি এসআর শিপিং কিনে নেয়। বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী এরকম মোট ২৩টি জাহাজ আছে কবির গ্রুপের বহরে।
২০১০ সালের ডিসেম্বরে আরব সাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল বাংলাদেশি জাহাজ জাহান মণি। ওই সময় জাহাজের ২৫ নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীকে জিম্মি করা হয়। নানাভাবে চেষ্টার পর ১০০ দিনের চেষ্টায় জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পান তারা।