২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৭:৪১:৫৮ অপরাহ্ন
নদীতে সেতু নির্মাণে বাড়ছে উচ্চতা
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-০৩-২০২৪
নদীতে সেতু নির্মাণে বাড়ছে উচ্চতা

সারা দেশের নদী ও নৌযান চলাচলের রুটগুলোকে নতুনভাবে শ্রেণিবিন্যাস করা হচ্ছে। শ্রেণি অনুযায়ী নদীর ওপর নতুন সেতু বা স্থাপনা নির্মাণ করতে পানির সর্বোচ্চ স্তর থেকে বিম পর্যন্ত উচ্চতা (উলম্ব ছাড়) বাড়ছে। নদীর ভেতরে এক পিলার থেকে আরেক পিলারের দূরত্বের (আনুভূমিক ছাড়) পরিমাপও বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া একটি সেতুর কমপক্ষে এক কিলোমিটারের মধ্যে আরেকটি সেতু নির্মাণের ওপর বিধিনিষেধ আসছে। একইভাবে গ্যাসলাইন, সাবমেরিন কেবল ও বৈদ্যুতিক তার নদীর নিচ দিয়ে এপার থেকে ওপারে নিতে গেলেও তলদেশ থেকে মাটির ভেতরের কত মিটার গভীরতা দিয়ে যাবে তাও নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে। এসব নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করে ‘অভ্যন্তরীণ নৌপথে স্থাপনাদি নির্মাণ বিধিমালা-২০২৪’-এর খসড়া চূড়ান্ত পর্যায়ে এনেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এরপর সেটি প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করবে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।


 


আরও জানা গেছে, খসড়া ওই বিধিমালায় অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় এলাকার ৩৬৭টি রুট এবং ১৬ হাজার ১৫৫ কিলোমিটার নৌপথ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮ হাজার ৭৬২ কিলোমিটার নৌপথে সারা বছর সর্বনিম্ন সাড়ে ছয় ফুট গভীরতা থাকবে বলে সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে। বাকি ৭ হাজার ৩৯৩ কিলোমিটার নৌপথে পানির প্রবাহ থাকবে বর্ষা মৌসুমে। নদীর গভীরতা এবং নৌযান চলাচলের সংখ্যার গুরুত্ব বিবেচনায় এসব নৌরুট ছয়টি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। এবারই প্রথম তিনটি নৌরুটের ৪৪৬ কিলোমিটার নৌপথকে ‘বিশেষ শ্রেণি’ হিসাবে ঘোষণা করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশের নৌপথ চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত। এই চার শ্রেণিতে ৯৫টি নৌরুট এবং ৫৯৬৮ কিলোমিটার নৌপথ আছে। নতুন বিধিমালায় ১০ হাজার ১৮৭ কিলোমিটার নৌপথ এবং ২৭২টি রুট বেশি ধরা হয়েছে। যদিও বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে নৌপথের দৈর্ঘ্য ৬ হাজার ১৯২ কিলোমিটার এবং বর্ষা মৌসুমে ৭ হাজার ৮৬২ কিলোমিটার।


নৌযান চলাচল ও পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে নদীর এই শ্রেণিবিন্যাস ও বিধিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। তাদের মতে, নতুন এ বিধিমালার প্রজ্ঞাপন জারি হলে সেতু বিভাগ, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ রেলওয়ে, এলজিইডি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নতুন নিয়মে স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে। নির্মাণের আগে বিআইডব্লিউটিএর ছাড়পত্রও নিতে হবে। নইলে নির্মিত স্থাপনা ‘অবৈধ’ গণ্য হবে। যেসব সেতু আগেই নির্মাণ হয়েছে সেগুলো এর আওতায় আসবে না। যদিও তালিকায় কয়েকটি নৌপথের শ্রেণি নির্ধারণ এবং ক্লিয়ারেন্স ছাড় নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে এলজিইডিসহ কয়েকটি বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের। ওইসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ভাষ্য, অনেক নদীতে পানির গভীরতা কম । সেখানে বড় আকারের নৌযান চলাচল করে না। কিন্তু শ্রেণিবিন্যাসের কারণে বেশি উচ্চতার সেতু বা অবকাঠামো তৈরি করতে গেলে নির্মাণ ব্যয় ও জটিলতা দুই বেড়ে যাবে।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, নদীর নাব্য ও নৌযান চলাচল বিবেচনায় রেখে নদীর শ্রেণিবিন্যাস করা হচ্ছে। বর্তমানে নতুন ধরন ও ডিজাইনের আধুনিক নৌযান আসছে। সরকারিভাবে পর্যটকবাহী জাহাজ নির্মাণ হচ্ছে। সেসব বিষয় বিবেচনায় রেখে নতুন নীতিমালা করা হচ্ছে। এই নীতিমালা সবাই অনুসরণ করলে নদীর নাব্য যেমন ঠিক থাকবে, তেমনি নৌযান চলাচলে বিঘ্ন হবে না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক সংস্থা তাদের ডিজাইন অনুযায়ী নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করেছে। এতে অনেক স্থানে নদী ও নৌপথের সমস্যা হচ্ছে। তবে নতুন নীতিমালায় ওইসব সেতু অক্ষত রাখার বিষয়ে ছাড় দেওয়া হচ্ছে।


শ্রেণিবিন্যাসে নতুন যা যুক্ত হচ্ছে : জানা গেছে, নদীর শ্রেণিবিন্যাসের খসড়া তালিকায় ৩৬৭টি নৌরুটের ১৬ হাজার ১৫৫ কিলোমিটার নৌপথকে ছয় শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে-বিশেষ, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি। বর্তমানে গভীরতার ভিত্তিতে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত নৌপথ রয়েছে। এবার ‘বিশেষ’ ও ‘পঞ্চম’ শ্রেণি যুক্ত হয়েছে। শ্রেণি অনুযায়ী নদীর সর্বনিম্ন গভীরতাও বেশি ধরা হচ্ছে। বিশেষ শ্রেণিভুক্ত ৩ নৌরুটে ৪৪৬ কিলোমিটার নৌপথ রয়েছে। এসব নৌরুটের সর্বনিম্ন গভীরতা ৪.৫ মিটার বা প্রায় ১৫ ফুট ধরা হয়েছে। অর্থাৎ এসব রুটে ভারী মালবাহী বা বড় আকৃতির নৌযান চলাচল করতে পারবে। উপকূলীয় জাহাজ চলাচল করতে পারবে। প্রথম শ্রেণির ৪১টি নৌরুটে দুই হাজার ৮৩৬ কিলোমিটার নৌপথ রয়েছে। সেখানে সর্বনিম্ন গভীরতা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ মিটার বা ১৩ ফুটের কিছুটা বেশি। এসব রুটেও বড় আকারের নৌযান চলাচল করতে পারবে। দ্বিতীয় শ্রেণির ৪৬টি নৌপথে দুই হাজার কিলোমিটার নৌপথের সর্বনিম্ন গভীরতা ২.৫ মিটার বা ৮ ফুটের বেশি। তৃতীয় শ্রেণির ১১২টি নৌরুটের তিন হাজার ৪৮০ কিলোমিটার নৌপথের গভীরতা ২ মিটার বা সাড়ে ছয় ফুট। এসব নৌপথে সারা বছরই সর্বনিম্ন গভীরতা অর্থাৎ নৌযান চলাচল উপযোগী থাকবে বলে সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এ বিধিমালা কার্যকর হলে শ্রেণি অনুযায়ী নৌপথের গভীরতা ধরে রাখার দায়িত্ব বর্তাবে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ওপর।


এছাড়া চতুর্থ শ্রেণির ১০৯টি রুটের ৪৪৭৬ কিলোমিটার নৌপথে সর্বনিম্ন ১.৫ মিটার এবং পঞ্চম শ্রেণির ৫৬টি নৌরুটে ২৯১৬ কিলোমিটার নৌপথে দেড় মিটারের কম গভীরতা ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির নৌপথ মৌসুমনির্ভর। অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমে এসব নদী নৌযান চলাচল উপযোগী।


নদী থেকে সেতুর উচ্চতা বাড়ছে : প্রস্তাবিত বিধিমালায় মাঝ নদী থেকে সেতুর বিম পর্যন্ত উচ্চতা (উলম্ব ছাড়) এবং এক পিলার থেকে আরেক পিলারের দূরত্ব (আনুভূমিক ছাড়) বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বিশেষ শ্রেণির নৌরুটের ওপর সেতু নির্মাণ করতে হলে ওই সেতুর গার্ডার বা বিম মাঝ নদীর পানির ‘স্ট্যান্ডার্ড উচ্চ লেভেল’ থেকে ২০ মিটার উলম্ব (পানির উপরিভাগ থেকে ব্রিজের বিম পর্যন্ত প্রায় ৬৬ ফুট ফাঁকা) রেখে নির্মাণ করতে হবে। নদীর ভেতরে এক পিলার থেকে আরেক পিলারের দূরত্ব রাখতে হবে (আনুভূমিক ছাড়) ১০০ মিটার বা ৩২৮ ফুট। বর্তমানে সর্বোচ্চ উলম্ব ছাড়ের পরিমাপ ১৮.৩০ মিটার এবং আনুভূমিক ছাড় ৭৬.২২ মিটার। নতুন বিধি কার্যকর হলে এসব রুটে সামনে যেসব সেতু নির্মাণ করা হবে সেগুলোর উচ্চতা বিদ্যমান মাপের চেয়ে ছয় ফুট আর এক পিলার থেকে আরেক পিলারের দূরত্ব ৭৮ ফুট বেশি ধরে ডিজাইন করতে হবে।


সংশ্লিষ্টরা জানান, কাঁচপুর সেতু থেকে নারায়ণগঞ্জ-চাঁদপুর হয়ে চট্টগ্রামের শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত ২৭৫ কিলোমিটার, পতেঙ্গা (কর্ণফুলীর নদীর পতিত মুখ)-মাতারবাড়ী পর্যন্ত ৯৮ কিলোমিটার এবং পতেঙ্গা থেকে মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল পর্যন্ত ৭৩ কিলোমিটার বিশেষ শ্রেণির নৌপথ হিসাবে ঘোষণা করা হচ্ছে।


একইভাবে প্রথম শ্রেণির নৌপথগুলোতে বিদ্যমান আনুভূমিক ছাড় ৭৬.২২ মিটার থেকে বাড়িয়ে ১০০ মিটার এবং উলম্ব ছাড় ১৮.৩০ মিটার থেকে বাড়িয়ে ১৮.৫০ মিটার করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির নৌপথে উলম্ব ছাড়া ৭.৬২ মিটার থেকে বাড়িয়ে ৮ মিটার এবং আনুভূমিক ছাড় ৩০.৪৮ মিটার থেকে বাড়িয়ে ৩৫ মিটার করা হচ্ছে। চতুর্থ শ্রেণির উলম্ব ছাড়া ৫ মিটার থেকে বাড়িয়ে ৮ মিটার এবং আনুভূমিক ছাড় ২০ মিটার থেকে বাড়িয়ে ৩৫ মিটার করা হচ্ছে। দ্বিতীয় শ্রেণির নৌপথে খুব একটা পরিবর্তন আসছে না। এ শ্রেণিতে উলম্ব ছাড় ১২.৫ মিটার এবং আনুভূমিক ছাড় ৭৫ মিটার করা হচ্ছে।


এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর হাইড্রোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক বেগম সামসুন নাহার যুগান্তরকে বলেন, অনেকগুলো দিক বিবেচনা করে সেতুর উলম্ব ও আনুভূমিক ছাড়ের পরিমাপ নির্ধারণ করা হয়েছে। সমীক্ষায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, কিছু নদীতে প্রবাহ আগের চেয়ে কমেছে। সেখানে বাস্তবে সেতুর উচ্চতা বাড়বে না। বাকি জায়গাগুলোতে নৌযান চলাচলের পরিসংখ্যান, নৌপথের গুরুত্ব ও ভবিষ্যৎ চিন্তা করে পরিমাপ বাড়ানো হয়েছে।


সরকারের বিভিন্ন সংস্থার আপত্তি : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খসড়া বিধিমালা, নদীর শ্রেণিবিন্যাস এবং সেতুর ক্লিয়ারেন্স ছাড় নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার আপত্তি রয়েছে। কোনো কোনো সংস্থা প্রস্তাবিত বিধিমালা কার্যকর করা যাবে কি না- তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর তাদের আপত্তিতে জানিয়েছে, ভারতে ভার্টিক্যাল ক্লিয়ারেন্স সর্বোচ্চ ১০ মিটার, সেখানে আমাদের সর্বোচ্চ ক্লিয়ারেন্স রাখা হয়েছে ২০ মিটার। এই পরিমাপ পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়ে সংস্থাটি আরও বলেছে, ঢাকার পার্শ্ববর্তী তুরাগ ও বালু নদীতে বর্ষা মৌসুমে কিছুদিনের জন্য পানির লেভেল ৫ মিটারে পৌঁছায়। বছরের বাকি সময় তা ২ মিটার থাকে। পানির সর্বোচ্চ লেভেল ধরে সেতু নির্মাণ করতে হলে খরচ অনেক বেড়ে যাবে।


প্রায় একই ধরনের মতামত দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এ প্রতিষ্ঠানটি উদাহরণ টেনে বলেছে, চট্টগ্রাম এলাকায় কালুরঘাট পর্যন্ত শ্রেণি-১ এবং তার ওপরের নৌপথ শ্রেণি-২ এ রাখা হয়েছে। আগে কালুরঘাট ব্রিজের ভার্টিক্যাল ক্লিয়ারেন্স ১২.৩ মিটার ছিল, যা ১২.৫ মিটার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই ২০ সেন্টিমিটার বেড়ে যাওয়ার ফলে সেতু নির্মাণ খরচ ৫৭ শতাংশ বাড়বে। পাশাপাশি রেলইঞ্জিনের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এলজিইডিসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের আপত্তি জানিয়েছে।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা যুগান্তরকে বলেন, আমরা বিভিন্ন সংস্থার পর্যবেক্ষণ পেয়েছি। কিছু পর্যবেক্ষণ সমন্বয় করা যাবে, কিছু সমন্বয় করা যাবে না। আমরা পুরো বিষয়টি নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।


শেয়ার করুন