২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৮:৪০:০০ অপরাহ্ন
কাগজেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-০৫-২০২৪
কাগজেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কাগজেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী দায়িত্ব গ্রহণের চার মাসের মাথায় গত এপ্রিলে দাবি করেন-মূল্যস্ফীতি পর্যায়ক্রমে নেমে আসছে।


এর আগে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গেল ডিসেম্বর ৮ শতাংশের ঘরে নেমে আসবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন।


সর্বশেষ দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণসংক্রান্ত বৈঠকে বলা হয়- ‘আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার’সংক্রান্ত কো-অডিনেশন কাউন্সিল বৈঠকে অর্থ বিভাগ বলেছে, সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ সাধন ও পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখায় পর্যায়ক্রমে কমে আসবে মূল্যস্ফীতি।


একইভাবে সরকারের নথিপত্রে আগামী তিন অর্থবছরের (২০২৪-২৫, ২০২৫-২৬ এবং ২০২৬-২৭) মূল্যস্ফীতির গড় লক্ষ্যমাত্রা ৬ শতাংশের উপরে অতিক্রম করবে না-এমন প্রাক্কলন করা হয়েছে।


তবে বিশ্লেষকদের অভিমত-নীতিনির্ধারকদের আশার বাণী এবং নথিপত্রে প্রাক্কলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু বাস্তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশে উঠেছে বলে বিআইডিএস’র গবেষণায় উঠে আসছে।


পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে গত মার্চে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। যার মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ।


অর্থনীতিবিদগণের শঙ্কা-আগামীতে মূল্যস্ফীতির হার আরও ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে। কারণ ডলারের মূল্য একলাফে ৭ টাকা বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতিতে চাপ থেকেই যাচ্ছে। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের জুনের মধ্যে সরকারের সংশোধিত মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা অত্যন্ত কঠিন।


সূত্র মতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। বিশ্ববাজারে পণ ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে অনেক দেশে মূল্যস্ফীতি ঘটে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক ও মূল্য হ্রাসের কারণে অনেক দেশে পর্যায়ক্রমে নেমে আসে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি উলটো আরও বাড়তে থাকে।


পরিস্থিতি মোকাবিলায় চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮ শতাংশে নেওয়া হয়। যদিও বিবিএসের হিসাবে এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি।


এদিকে সরকারের ‘আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হারসংক্রান্ত কো-অডিনেশন কাউন্সিল’ বৈঠকে আগামী তিন অর্থবছরের মূল্যস্ফীতির প্রাক্কলিত লক্ষ্যমাত্রার অনুমোদন দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। সেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এটি আগামী বাজেটে ঘোষণা দেওয়া হবে। এর বাইরে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৬ শতাংশ এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরের ক্ষেত্রে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।


জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, মূল্যস্ফীতি কমানোর কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কী করলে সেটি কমবে, সেভাবে নীতি গ্রহণ করলে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে। ফিসক্যাল পলিসিতে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কী পরিবর্তন হবে, বাজেট ঘাটতি কমানোর কী উদ্যোগ থাকছে সেটি বলতে হবে।


এছাড়া টাকা ছাপিয়ে অর্থায়ন এবং ঘাটতি বাজেট পূরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ বন্ড ইস্যু করে টাকা না নেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত আসলে বুঝতে সুবিধা হবে যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যে প্রাক্কলন করা হয়েছে সেদিকে যাবে কিনা। এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে দেখতে হবে সরকারের সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা রূপরেখার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা।


আমাদের মূল্যস্ফীতি নির্ভর করে আংশিক আন্তর্জাতিক মূল্য ও আংশিক অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর। বিগত দুবছরে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বেড়েছে, ওই সময় দেশেও বেড়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক কমলেও আমাদের মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলছে। ফলে বিশ্ববাজারে দাম কমলেই দেশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূল্যস্ফীতি কমবে সেটি ধরে নেওয়া যায় না। এখন কতটা পণ্য আমদানি করতে পারছি, ডলারের মজুদ কেমন, ঘাটতি বাজেটের জন্য কতটা টাকা ছাপানো হচ্ছে, মুদ্রানীতি সংকোচন না সম্প্রসারণ দেওয়া হচ্ছে, রাজস্বনীতি এসবের ওপর নির্ভর করছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ।


মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থ বিভাগের এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন বলা হয়, ২০০৯-২০২১ সাল পর্যন্ত দেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছরে প্রতি মাসে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে বিরাজ করে। কোভিড মহামারির পর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় অস্থিরতা দেখা দেয়। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকলে এর প্রভাব এসে পড়ে বাংলাদেশের ওপর। সেখানে আরও বলা হয়, এরই মধ্যে বিশ্বের অনেক দেশের মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হয়। ২০২২ সালে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছরে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসবে। আইএমএফের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, উন্নত বিশ্বে ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) মূল্যস্ফীতি ২০২৩ সালে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে ২০২৪ সালে ২ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসছে। উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি ২০২৩ সালে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ থাকলেও ২০২৪ সালে প্রাক্কলন করেছে ৮ দশমিক ১ শতাংশ।


একইভাবে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে গত জানুয়ারিতে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ হয়, ফেব্রুয়ারিতে কমে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ হয়। কিন্তু মার্চে আবার বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। এডিবির পূর্বাভাসে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার ৮ দশমিক ৪ শতাংশে উঠতে পারে।


বিশেষজ্ঞদের মতে, মূল্যস্ফীতির হার কাগজ-পত্রে নিয়ন্ত্রণমূলক ধরা হলেও বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। চলতি অর্থবছর শেষ হতে ৬ সপ্তাহ বাকি। ধারণা করা হচ্ছে এপ্রিলেও ১০ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে। কারণ আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে ডলারের মূল্য যেভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে সে কারণেই সংকট বাড়ার শঙ্কা রয়েছে।


কিন্তু যদি সংকট হয় আমদানির ওপর যে নিয়ন্ত্রণ সেটি বেশি দিন ধরে রাখা যাবে না। এতে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ থেকেই যাবে।


এদিকে আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হারসংক্রান্ত বৈঠকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন অর্থ সচিব মো. খায়রুজ্জামান মজুমদার। তিনি বলেছেন, খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্য কমে আসায় ২০২৪ এবং ২০২৫ সালে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে।


এছাড়া সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ সাধন, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে। এছাড়া পণ্যের বাজার মনিটরিং, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বৃদ্ধি করা এবং জ্বালানি তেলের মূল্য বিশ্ববাজারের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বয় ব্যবস্থা বাস্তবায়ন হচ্ছে। যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রভাব ফেলবে।


পাশাপাশি ভোক্তার চাহিদা হ্রাসের লক্ষ্যে নীতি সুদ হার বাড়ানো ও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণের কারণে ২০২৪ সালে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ এবং ২০২৫ সালে আরও কমে আসবে।


ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্যে সুদের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৯ শতাংশ সুদ হারের ক্যাপ তুলে নেওয়া হয়। এ উদ্যোগের ফলে ব্যাংকের তারল্য আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে।


এর ফলে বাজারে ভোক্তার চাহিদা হ্রাস পাবে এবং মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক হবে। তিনি আরও বলেন, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির আওতায় সরকারের উন্নয়ন খাতে ঋণ বন্ধ রেখেছে।


পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ব্যয় মেটাতে রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করা হচ্ছে। এসব পদক্ষেপের ফলে আগামীতে মূল্যস্ফীতি পর্যায়ক্রমে কমে আসবে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থনৈতিক কারণগুলোকে রাজস্ব ও মুদ্রানীতির মাধ্যমে মোকাবিলা সম্ভব। কিন্তু অ-অর্থনৈতিক (রাজস্ব ও মুদ্রানীতিবহির্ভূত) কারণগুলো মোকাবিলা সম্ভব নয়। এজন্য অ-অর্থনৈতিক কারণগুলো মোকাবিলা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেন তিনি।


শেয়ার করুন