সরকারবিরোধী আন্দোলন পুনরুজ্জীবিত করতে আবারও রাজপথে সক্রিয় হতে চাইছে বিএনপি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চার মাস পর হঠাৎ এ অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের বিশেষ ইঙ্গিত থেকে দলটির নীতিনির্ধারক মহল এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনেকটা তড়িঘড়ি করে বেশকিছু কর্মসূচি সামনে আনা হয়।
এর মধ্যে শুক্র ও শনিবার ঢাকায় বেশ বড় আকারের জনসমাবেশ করতে সক্ষম হয়েছে দলটি। সমাবেশের পর নেতাকর্মীরা আরও উজ্জীবিত হয়েছে বলে মনে করছেন নীতিনির্ধারকরা।
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো এসব তথ্য নিশ্চিত করে যুগান্তরকে আরও জানায়, সামনে কী ধরনের কর্মসূচি নেওয়া যায়, তা ঠিক করতে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি হাইকমান্ড থেকে সভা অব্যাহত আছে। দলটির ভ্যানগার্ড খ্যাত সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলও সারা দেশে জেলায় জেলায় কর্মিসভা শুরু করেছে।
একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে কৃষক দলও। একই সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব কমানোর পাশাপাশি তাদের মাঠের আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকায় দেখতে চায় বিএনপি। সেজন্য দীর্ঘ চার মাস পর সমমনাদের সঙ্গেও ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করছে।
আজ ১২ দলীয় জোট ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক দল-এলডিপির সঙ্গে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি বৈঠকে বসছে। কাল বৈঠক করবে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও লেবার পার্টির সঙ্গে।
বৈঠকের কথা স্বীকার করে ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা যুগান্তরকে বলেন, রোববার (আজ) বেলা ৩টায় বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে বৈঠক হবে। সেখানে আন্দোলনের কর্মসূচিসহ চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর অনেকটাই ‘স্থবির’ সরকারবিরোধী আন্দোলন। বিএনপি নিজস্ব কর্মসূচি পালন করছে। মিত্র দলগুলোও নিজেদের মতো করে মাঝেমধ্যে পৃথক কর্মসূচি পালন করছে। ১৩ জানুয়ারির পর লিয়াজোঁ কমিটির কোনো বৈঠক হয়নি। যুগপৎ কর্মসূচিতেও নেই। সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় বেশ কয়েকটি দল একেবারেই নিষ্ক্রিয় ভূমিকায়।
সরকারবিরোধী একদফার আন্দোলনে লক্ষ্য অর্জন না হওয়ায় ক্রমেই বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব চলছিল সমমনা দলগুলোর। এমন পরিস্থিতিতে বুধবার গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সমমনা দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে স্কাইপে কথা বলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এরপরই দ্রুত পরিস্থিতি পালটাতে থাকে।
পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে ধারাবাহিক বৈঠকের সিদ্ধান্ত হয়। আজ বিকালে গুলশান কার্যালয়ে প্রথমে ১২ দলীয় জোট এবং পরে এলডিপির সঙ্গে বৈঠক রয়েছে। সোমবার জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও লেবার পার্টির সঙ্গে বৈঠক হবে।
এসব বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান অংশ নেবেন। সমমনা ছাড়াও সরকারবিরোধী আন্দোলনে মাঠে থাকা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও ধারাবাহিকভাবে বিএনপির বৈঠক করার কথা রয়েছে।
হঠাৎ ফের মাঠের আন্দোলনে নামার পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কোনো নেতা বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একজন নীতিনির্ধারক যুগান্তরকে বলেন, তাদের কাছে মনে হচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এখন ক্ষমতাসীন দল অর্থনৈতিক সংকটসহ নানা কারণে বেকায়দায় পড়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে ভূরাজনীতি। ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুতে স্বার্থের দ্বন্দ্বে হঠাৎ ভূরাজনীতির পাশা এখন উলটে যাচ্ছে। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো এ অঞ্চলে যার যার জাতীয় স্বার্থকে বড় করে দেখছে। ফলে অনেক ফোরকাস্ট নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকদেরও ঘুম হারাম।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভূরাজনীতি আর মাঠের রাজনীতির দূরত্ব বেশি নয়। একটি ছাড়া আরেকটি অচল। সংগত কারণে বিএনপিকেও এখন জাতীয় স্বার্থ ও জনস্বার্থের অনেক বিষয় সামনে নিয়ে মাঠে নামতে হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। নির্বাচনের আগে এশিয়ার দুই শক্তিধর দেশের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের যে সম্পর্ক ছিল, নির্বাচনের পর এখন বিনিয়োগকেন্দ্রিক জাতীয় স্বার্থের দ্বন্দ্ব নতুন মেরুতে অবস্থান নিয়েছে। ফলে এ ইস্যুতে বাংলাদেশের সামনেও কঠিন পরীক্ষা। কে কার পক্ষ নেবে, কে কার প্রকৃত বন্ধু। সব হিসাবনিকাশ এলামেলো হয়ে যাচ্ছে খুব দ্রুত। এ অবস্থায় বিএনপির মতো বৃহৎ দল বসে থাকতে পারে না। সৃষ্ট জটিল সমীকরণ বিএনপি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
এদিকে বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে অনেকে এখন বিএনপির সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী বলে কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতা জানিয়েছেন। তারা আরও জানান, ক্ষমতাধর একটি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কয়েকবার বৈঠকও হয়েছে বিএনপি নেতাদের। বিষয়টি দলের হাইকমান্ড অবহিত আছেন।
তাছাড়া উপজেলা পরিষদের প্রথম ধাপের ভোটও জনগণ বর্জন করেছে, যা বিদেশিরাও পর্যবেক্ষণ করেছেন। উপজেলার ভোট বর্জনের মধ্য দিয়ে জনগণ আবারও পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, বর্তমান সরকারকে তারা সমর্থন করছে না। যে কারণে বিএনপি আবারও মাঠের আন্দোলনে নামতে চায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বগতি, তেল-গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিসহ জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে কর্মসূচি আসবে।
তবে কী ধরনের কর্মসূচি হবে, তা দলের সিনিয়র নেতা ও মিত্রদের সঙ্গে পরামর্শ করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। নেতারা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু চলতি সপ্তাহে দুইদিনের সফরে ঢাকায় আসছেন। তার সঙ্গেও বৈঠক হতে পারে বিএনপির। এমনকি ওই সময়ে রাজধানী ঢাকায় কোনো সমাবেশের কর্মসূচিও দেওয়া হতে পারে।
এদিকে বিএনপির পাশাপাশি অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনও মাঠে নেমেছে। সংগঠনকে সুসংগঠিত, শক্তিশালী ও গতিশীল করার লক্ষ্যে রাজশাহী বিভাগ থেকে কর্মিসভা শুরু করেছে ছাত্রদল। এ কর্মিসভা পর্যায়ক্রমে সব সাংগঠনিক জেলায় করা হবে।
এছাড়া শনিবার নয়াপল্টনে এক জরুরি সভায় সারা দেশে কর্মিসভা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয়তাবাদী কৃষক দলও। এজন্য বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমও গঠন করেছে সংগঠনটি। কর্মিসভা সফলে সব জেলা ও মহানগরে কেন্দ্রীয় নেতাদের দলনেতা করে এই টিম গঠন করা হয়।
অন্যান্য অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনেরও একই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। এতে আবারও নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হবেন এবং মনোবল ফিরে পাবেন বলে মনে করছেন বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা। বিএনপির কর্মীসূচি সফলে যা কাজে লাগবে বলেও মনে করছেন তারা।