সুদের হার বৃদ্ধির পরও আশানুরূপ আমানতের দেখা মিলছে না। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ, আস্থা সংকটসহ নানা কারণে বিদ্যমান আমানতের অর্থও ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এতে সার্বিক ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী হয়ে পড়েছে। সর্বশেষ গত মার্চে বার্ষিক আমানতের প্রবৃদ্ধি আবার এক অঙ্কের ঘরে নেমেছে। ওই মাসে আমানতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয় ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ, যা গত পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
আমানতের প্রবৃদ্ধি কমার সঙ্গে নগদ টাকা তুলে ঘরে রাখার প্রবণতা আবার বেড়েছে। গত মার্চ মাসেই গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি তুলে নিয়েছে। এসব টাকা ওই মাসে আর ব্যাংকে ফেরত আসেনি। সব মিলে গত পাঁচ মাসের ব্যবধানে ব্যাংকের বাইরে অর্থ বেড়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমানতের প্রবৃদ্ধি কমার মূল কারণ হতে পারে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এর প্রভাবে মানুষ নতুন করে সঞ্চয় করতে পারছে না। এ ছাড়া আস্থা সংকট ও দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণ আতঙ্কেও আমানত তুলে নেওয়া হতে পারে। অন্যদিকে রোজা ও ঈদের কারণে নগদ টাকা তুলে খরচ করা হতে পারে। ফলে ওই মাসে ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ বেড়েছিল।
জানা যায়, বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ঋণের সুদে ৯ শতাংশের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। তবে ওই সুদহারের সীমা কার্যকর হওয়ার আগেই দেশে মহামারি করোনার আঘাত আসে। ফলে সে সময়ে নিম্ন সুদহারের পরও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ সেভাবে আকৃষ্ট হয়নি। উল্টো ঋণের সুদহার কমায় আমানতের সুদও ব্যাপক হারে কমে যায়।
এরপর চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ওই সীমা প্রত্যাহার করে স্মার্ট পদ্ধতিতে সুদহার নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরে সুদহারের ব্যবধানের (স্প্রেড) সীমাও তুলে নেওয়া হয়। আর গত সপ্তাহে স্মার্ট পদ্ধতি তুলে দিয়ে সুদহার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূলত উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচমূলক মুদ্রা সরবরাহ নীতির আওতায় সব ধরনের ঋণের সুদ বাড়ানোর পথে হাঁটছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বর্তমানে কোনো কোনো ব্যাংক আমানতে ৯ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। তার পরও নতুন আমানতের দেখা মিলছে কম। আবার বিদ্যমান আমানত তুলে নেওয়ার ঘটনা বেড়েছে। সূত্রগুলো বলছে, ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি আমানত তুলে নেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, নির্বাচনের আগেও ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছিল। তখন অবশ্য রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ভীতি ও আতঙ্ক বিরাজ করছিল জনমনে। আবার নির্বাচনের খরচের জন্যও টাকা তোলার চাপ বেড়েছিল। তবে মার্চে দেশের পরিস্থিতি ছিল স্বাভাবিক। এ সময়ে টাকা তুলে নেওয়ার একটিই কারণ হতে পারে রোজা ও ঈদ-উৎসব। এ ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণেও ব্যাংক থেকে টাকা তুলে খরচ করার প্রবণতা বাড়তে পারে।
আমানতের প্রবৃদ্ধি ফের নিম্নমুখী : গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৭৫ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা। যা ২০২৩ সালের মার্চে ছিল ১৫ লাখ ২৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। ফলে গত এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি গত ৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোনো মাসেই আমানতের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের নিচে নামেনি। আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে আমানতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ। তার আগের মাস জানুয়ারিতে ছিল ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর গত ডিসেম্বরে ছিল ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ। এর আগে ২০২১ সালের মে মাসে এ খাতে আমানতে প্রবৃদ্ধি উঠেছিল সর্বোচ্চ ১৪ দশনিক ৪৭ শতাংশ।
ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ বেড়েছে : গত মার্চ শেষে ব্যাংকব্যবস্থার বাইরে মানুষের হাতে থাকা টাকা পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। আগের মার্চ ফেব্রুয়ারিতে যা ছিল ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে মানুষের হাতে নগদ টাকা বেড়েছে প্রায় ৩ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। তথ্য ঘেঁটে আরও দেখা যায়, গত বছরের অক্টেবরের পর থেকেই ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ বাড়ছে। ওই মাসে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। নভেম্বরে তা বেড়ে হয় ২ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। এরপর ডিসেম্বরে তা আরও বেড়ে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৮৬০ কোটি, জানুয়ারিতে ২ লাখ ৫৭ হাজার ২৯৫ কোটি, ফেব্রুয়ারিতে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৪ কোটি এবং সর্বশেষ মার্চে তা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ পাঁচ মাসে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে নগদ টাকা বেড়েছে প্রায় ১৫ হাজার ২৫২ কোটি টাকা।
বেড়েছে ঋণের প্রবৃদ্ধিও : গত ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকগুলোর ঋণ ও বিনিয়োগ স্থিতি ছিল ১৯ লাখ ৮৩ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা, যা মার্চে বেড়ে হয়েছে ২০ লাখ ১১ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। ফলে এক মাসের ব্যবধানে ঋণ ও বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ দশমিক ৪ শতাংশ। আর গত বছরের ব্যবধানে ঋণ ও বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ১১ শতাংশ।