হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যু একটি সংকটে ফেলে দিয়েছে ইরানকে। কারণ, দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির কাছ থেকে রাইসির কাছে সহজ ও স্বাভাবিক ক্ষমতা হস্তান্তরের যে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল, তা আর হচ্ছে না। রাইসির মৃত্যুর পর পরবর্তী সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা কে হবেন—সেটা নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, রাইসিকে বিবেচনা করা হচ্ছিল খামেনির বিকল্প হিসেবে। এমনকি তিনি দেশটির ক্ষমতাধর বাহিনী রেভল্যুশনারি গার্ডেরও পছন্দের ব্যক্তি ছিলেন।
ইরান বেশ কিছু সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশটিতে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বিক্ষোভ হয়েছে। অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে, দুর্নীতি বেড়েছে। এ ছাড়া ইসরায়েলের সঙ্গে বিবাদ বেড়েছে দেশটির। এই পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, রাইসির মৃত্যুর কারণে ইরানের রাজনীতিতে খুব বেশি পরিবর্তন আসবে না। বরং কট্টরপন্থীরাই দেশটির ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। আর খামেনি দেশের গন্তব্য যে দিকে নির্ধারণ করেছেন, তা থেকে কোনো বদল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। নতুন প্রেসিডেন্ট চাইলেও সেটা পারবেন না।
এ প্রসঙ্গে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরানবিষয়ক পরিচালক আলী ভায়েজ বলেন, দেশটি কীভাবে পরিচালিত হবে, সেটা ইতিমধ্যেই ঠিক করা আছে। এর মধ্য দিয়ে এটা নিশ্চিত করা হয়েছে, পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা যিনি হবেন, তিনি আসলে ওই পথেই হাঁটবেন। তিনি বলেন, ইরানের পররাষ্ট্রনীতি বেশ খানিকটা কট্টরপন্থী। এই নীতির কারণে এই অঞ্চলের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ইরানের কাছ থেকে সহযোগিতা পাবে। আর ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে যা করছে তা-ও চলতে থাকবে।
আলী ভায়েজের মতে, প্রেসিডেন্ট যিনি হোন না কেন, তিনি এসে ইরানের বর্তমান নীতির বাইরে যেতে পারবেন না। তাঁর সঙ্গে অনেকটাই একমত ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ইরান বিশেষজ্ঞ এলি গেরানমায়ে। তিনি বলেন, ইরানের পররাষ্ট্রনীতিতে তেমন কোনো পরিবর্তন আসবে না। এ ছাড়া আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে তাদের যে সম্পর্ক এবং পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচিতেও কোনো পরিবর্তন আসবে না। তাঁর মতে, এই বিষয়গুলো আসলে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা এবং রেভল্যুশনারি গার্ড।
এখানে রাইসির কিছু সুবিধা ছিল। তিনি রেভল্যুশনারি গার্ডের ওপর খানিকটা প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন। এই বাহিনীর সঙ্গে তাঁর কোনো বিরোধ ছিল না। তাঁর পূর্বসূরি হাসান রুহানির থেকে কট্টরপন্থী ছিলেন তিনি। আর এ জন্য রেভল্যুশনারি গার্ডও তাঁকে ব্যবহার করতে পেরেছে। তবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাইসি যেভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাতে তাঁর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সর্বোচ্চ নেতা হওয়ার যোগ্যতা তাঁর আছে কি না, এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল।
রাইসির জন্য মূলত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আসলে খামেনির ছেলে মোজতবা খামেনি। যদিও সর্বোচ্চ পদে তাঁর প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি ইরানের অতীতের রাজতন্ত্রের কথাই মনে করিয়ে দেয়। রাইসির মৃত্যুর পর সর্বোচ্চ নেতা হওয়ার সুযোগ বেড়েছে মোজতবার। তবে এটা খুবই কঠিন। কারণ, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি বেশ রহস্যজনক। অ্যাসেম্বলি অব এক্সপার্টে থাকা ধর্মীয় নেতারা মূলত নির্ধারণ করে থাকেন কে হবেন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা।
এ প্রসঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরানবিষয়ক পরিচালক আলী ভায়েজ বলেন, ইরানের যেকোনো নির্বাচনই প্রহসন। কারণ, ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমালোচক হলে কেউ প্রার্থী হতে পারেন না। মূলত রাষ্ট্রের যে মূলনীতি, তার ওপরই বেশ জোর দেওয়া হয় ইরানে। এতে যদি কোনো বৈধ প্রার্থীও বাদ পড়েন, তাতেও আসলে তারা নির্বিকার। এসব কারণে ইরানে নির্বাচনে ভোট পড়ছে কম। যেমন সর্বশেষ তেহরানের একটি নির্বাচনে ভোট পড়েছে ১০ শতাংশের আশপাশে।
এদিকে ইরান সম্প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি হামলায় জড়িয়েছে। একই সঙ্গে তারা ফিলিস্তিনের হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনে হুতিদের সমর্থন এবং সাহায্য করছে। সম্প্রতি এই অঞ্চলের উত্তেজনা কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনাও করেছে দেশটি। আবার দেশের ভেতরেও অসন্তোষ রয়েছে। সেই সঙ্গে সর্বোচ্চ নেতা খামেনির শারীরিক অবস্থাও খারাপের দিকে। আর এরই মধ্যে রাইসির মৃত্যু একধরনের চাপে ফেলেছে সরকার ও শাসকগোষ্ঠীকে। সব মিলিয়ে সুযোগটা নিচ্ছে রেভল্যুশনারি গার্ড। কারণ, শাসকগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা নিয়ে ভয় আছে। ফলে কট্টর নেতৃত্বের দিকেই যাচ্ছে ইরান।