পিরোজপুরের চরখালী পয়েন্টে কঁচা নদীর ওপর হচ্ছে সেতু। রোববার ঢাকায় এ ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় ওই ঘোষণা দেন তিনি। ‘চীন বাংলাদেশকে কিছুই দেয়নি’-এ সমালোচনার জবাবে সেতু নির্মাণের কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। চীনের সহায়তায় সেতুটি হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এ ঘোষণায় উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে দক্ষিণ উপকূলের ৩ জেলা বরগুনা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরে। এ সেতু দক্ষিণের সড়ক যোগাযোগে আরেক দফা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে বলছে সবাই। সেতু হলে বরগুনার মানুষকে আর বরিশাল ঘুরে যেতে হবে না সমুদ্রবন্দর মোংলা কিংবা স্থলবন্দর বেনাপোল।
পায়রা আর মোংলা বন্দরের যোগাযোগেও হবে অগ্রগতি। সহজেই যাওয়া যাবে ঢাকাসহ বেনাপোল-খুলনা-মোংলা। এক্ষেত্রে ৬০ কিলোমিটার পথ কমে যাওয়ার পাশাপাশি থাকবে না কোনো ফেরি। উপকূলের অর্থনীতিতেও আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
খুলনা-মোংলা কিংবা বেনাপোল যেতে দারুণ ঝক্কি পোহাতে হয় বরগুনার মানুষকে। মৎস্য বন্দর পাথরঘাটার ক্ষেত্রেও একই সমস্যা। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মাছ পরিবহণে দুর্ভোগ পোহাতে হয় ব্যবসায়ীদের। চরখালী এসে ফেরির জন্য বসে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একই সমস্যা পিরোজপুরের দক্ষিণ অংশের মানুষেরও। ২০২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর জেলার বেকুটিয়ায় চালু হয় অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু। বেগম ফজিলাতুন নেছার নামে হওয়া এ সেতু বরিশালের সঙ্গে মোংলা-বেনাপোলের যোগাযোগ সহজ করলেও পিছিয়ে থাকে বরগুনা-পিরোজপুরের বড় একটা অংশ। কারণ, ওই সেতু পার হয়ে যেতে তাদের অতিরিক্ত পাড়ি দিতে হয় ৬০ কিলোমিটার পথ। ফলে চরখালী ফেরি পার হয়েই অব্যাহত থাকে তাদের যাতায়াত। এরই মধ্যে ৫ ফেব্রুয়ারি চরখালী পয়েন্টে সেতু নির্মাণের অনুরোধ জানিয়ে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে চিঠি দেন পিরোজপুর-২ (ভান্ডারিয়া-কাউখালী-স্বরূপকাঠী) আসনের সংসদ-সদস্য মহিউদ্দিন মহারাজ। চিঠি পাওয়ার পর সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই ও স্থান নির্ধারণের নির্দেশ দেন মন্ত্রী। সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করে সেতু মন্ত্রণালয়। এরপর ১ মে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে দেওয়া এক চিঠিতে সেতু নির্মাণে বৈদেশিক সহায়তার ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানায় সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকালে এ সেতু নির্মাণে সহায়তা করতে রাজি হয় চীন। ১০ জুলাই এ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয় দুই দেশের মধ্যে। চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে ওই চুক্তি স্বাক্ষরকালে উপস্থিত ছিলেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী।
মন্ত্রণালয় সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ২ হাজার ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে এ সেতু নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৫০ কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ। বাকি ৪ হাজার ২৫০ কোটি টাকা দেবে চীন। মূল সেতু ছাড়াও প্রকল্পের আওতায় নির্মিত হবে ২ হাজার ৭৭০ মিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক। ৩ হাজার মিটার এলাকাজুড়ে হবে নদীশাসন। প্রকল্পের আওতায় অধিগ্রহণ করতে হবে ২শ একর জমি। বর্তমানে যেখানে চরখালী ফেরি রয়েছে, সেখান থেকে ৫শ ফুট উত্তরে হবে এ সেতু। আলোচ্য স্থানে নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় কিলোমিটার।
কাজ শুরুর পর সেতু নির্মাণ শেষ হতে ৫ বছরের মতো সময় লাগবে। এটি নির্মিত হবে সরাসরি চায়না সরকারের তত্ত্বাবধানে। পিরোজপুর-২ আসনের সংসদ-সদস্য মহিউদ্দিন মহারাজ বলেন, ‘জাতির পিতার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চেয়েছেন বলেই আমাদের ভাগ্যের দুয়ার খুলেছে। এই একটি সেতুর জন্য বহু বছরের অপেক্ষা ছিল মানুষের। এ সেতু দক্ষিণ উপকূলের ভাগ্য বদলে দেবে। ব্যবসা-বাণিজ্য আর অর্থনীতিতে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এজন্য পিরোজপুর-২ নির্বচনি এলাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
চরখালী পয়েন্টে সেতু হলে পিরোজপুর, বরগুনা আর পটুয়াখালীর মানুষের যে কতটা উপকার হবে, তার খানিকটা বর্ণনা দিয়েছেন সেখানকার সুশীল সমাজের নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা। বাংলাদেশ মৎস্য ট্রলার মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘দেশের অন্যতম বৃহৎ মৎস্য বন্দর পাথরঘাটা থেকে প্রতিবছর বেনাপোল হয়ে বিদেশে রপ্তানি হয় শতকোটি টাকার মাছ। রাজধানীসহ দেশের নানা প্রান্তেও মাছ যায় এখান থেকে। পদ্মা সেতু হলেও এর পুরোপুরি সুফল পাচ্ছিলাম না চরখালী ফেরির কারণে।
ফেরিঘাটে অপেক্ষা করতে গিয়ে যেমন মাছ পচে যেত, তেমনই পরিবহণ ব্যয়ও বাড়ত অনেক। সেতু হলে এসব সমস্যা থাকবে না।’ বরগুনা জেলা পর্যটন উদ্যোক্তা ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট সোহেল হাফিজ বলেন, ‘বরগুনা থেকে দুটি উপায়ে খুলনা-মোংলা কিংবা বেনাপোলে যাওয়া যায়। এর একটি হলো প্রায় ১০০ কিলোমিটার অতিরিক্ত পথ ঘুরে বরিশাল হয়ে আর অপরটি কাকচিড়া-চরখালী ফেরি পার হয়ে গন্তব্যে পৌঁছা।
চরখালী পয়েন্টে ফেরি হলে আর বরিশাল ঘুরে যেতে হবে না। এক্ষেত্রে কাকচিড়া পয়েন্টেও যদি সেতু হতো, তাহলে আর কোনো ফেরিই থাকত না। চরখালীতে যখন হচ্ছে, তখন কাকচিড়াতেও একসময় সেতু হবে বলে আমরা আশাবাদী। চরখালীতে সেতু হলে দেশের যে কোনো জায়গায় পৌঁছাতে আগের চেয়ে ১ ঘণ্টা সময় কম লাগবে আমাদের।’
কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার হাওলাদার বলেন, ‘চরখালী পয়েন্টে সেতু হওয়া মানে পায়রা বন্দরের সঙ্গে মোংলা বন্দরের সহজ সড়ক যোগাযোগে আরও এক ধাপ অগ্রগতি। প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতায় চরখালীতে সেতু হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে পুরাকাটা আর কাকচিড়া পয়েন্টেও সেতু হবে।’