২২ নভেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ১২:০৭:৫৯ পূর্বাহ্ন
যুবকের বৈঠক হচ্ছে না আজ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৭-২০২২
যুবকের বৈঠক হচ্ছে না আজ

দীর্ঘ সাত বছর পর ‘যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি (যুবক)’ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সরকারের উচ্চপর্যায়ে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আজ (রোববার) বিকাল ৪টায় বৈঠক আহ্বান করা হয়েছিল। তবে সেটি আজ অনুষ্ঠিত হবে না।

বৈঠকের সভাপতি বাণিজ্য সংগঠন (ডিটিও) অনুবিভাগের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. হাফিজুর রহমানের করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসায় এই বৈঠক স্থগিত করা হয়েছে। ঈদুল আজহার ছুটির পর বৈঠকের নতুন তারিখ ধার্য করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

জানা গেছে, যুবকের সব সম্পত্তি সরকারি হেফাজতে গ্রহণ ও বিক্রি করে গ্রাহকের টাকা পরিশোধসংক্রান্ত সরকারের সব স্তরের নির্দেশনা রহস্যজনক কারণে আলোর মুখ দেখেনি। এমনকি এই সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন ছয় বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়া দুই বছর আগে একই বিষয়ে যুবকে প্রশাসক নিয়োগ করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বর্তমান অর্থমন্ত্রীর অনুরোধও অদ্যাবধি কার্যকর হয়নি। পাশাপাশি যুবক নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে সাড়ে সাত বছর আগে সরকারের একটি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের কমিটির সুপারিশও ঝুলে আছে।

প্রায় এক যুগ আগে সরকারের পৃথক দুটি কমিশন যুবকের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করেছিল। এগুলোও আলোর মুখ দেখেনি।

শুধু তাই নয়, প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নেওয়া অভিযোগের মামলায় যুবকের প্রতিষ্ঠা নির্বাহী পরিচালক হোসাইন আল মাসুমসহ সাতজনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেয় সিআইডি। এরপর গত ডিসেম্বরে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদলত। কিন্তু গ্রেফতার তো দূরের কথা, রীতিমতো নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়ান তারা-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, মাথায় গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়েই যুবকের কয়েকশ কোটি টাকার সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছেন তারা। অথচ তিন লাখ গ্রাহক আড়াই হাজার কোটি টাকা হারিয়ে পথে বসেছেন। অনেকে ইতোমধ্যে মারাও গেছেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন-যুবকের খুঁটির জোর কোথায়? তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কি কেউ নেই?

এমন পরিস্থিতিতে ভবিষ্যৎ করণীয় ঠিক করতে আজ রোববার বিকাল ৪টায় ‘যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি (যুবক)’ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সরকারের উচ্চপর্যায়ে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি বৈঠক আহ্বান করেছিল। 

সূত্র জানায়, প্রতারণার মাধ্যমে ২ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে যুবক। গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার কৌশল নির্ধারণ করতে গত ১৬ বছরে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সরকারিভাবে। কিন্তু প্রতিটি উদ্যোগ রহস্যজনকভাবে অন্ধকারে চলে গেছে। সর্বশেষ গত বছর ২২ সেপ্টেম্বর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ই-কমার্স প্রতারণা নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত এক বৈঠকে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ন্যায্যমূল্যে যুবকের সম্পত্তি বিক্রি করা হলে এর অর্থ দিয়ে গ্রাহকদের অর্ধেক দায়-দেনা মেটানো সম্ভব। এ নিয়ে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন। এরপর দীর্ঘ আট মাস কেটে গেছে। এ নিয়ে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

এর আগে ২০২০ সালে যুবকের বেদখল সম্পত্তি সরকারি হেফাজতে নিয়ে তা বিক্রির মাধ্যমে গ্রাহকদের পাওনা বুঝিয়ে দিতে একজন প্রশাসক নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদন দেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সেটি কার্যকর করতে পাঠানো হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। এখানে এসে আবারও রহস্যজনকভাবে সেটি অন্ধকারে চলে গেছে।

২০১৬ সালের জুনে যুবকের ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা চাওয়া হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়ার নির্দেশনা দেন। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনও বাস্তবায়ন হয়নি। 

২০১৪ সালের ২৫ নভেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত ‘আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি’ যুবকের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধের জন্য একজন ‘প্রশাসক’ নিয়োগের সুপারিশ করে প্রতিবেদন দাখিল করেছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এ সুপারিশ আলোর মুখ দেখেনি।

এছাড়া অতিরিক্ত সচিব রফিকুল ইসলামকে চেয়ারম্যান করে ২০১১ সালের ৪ মে যুবকের সমস্যা সমাধানের জন্য কমিশন গঠন করে সরকার। কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়, ২ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে যুবক। ৩ লাখ ৩ হাজার ৭০০ গ্রাহকের কাছ থেকে এ টাকা নেওয়া হয়। গ্র্রাহককে অর্থ ফেরত দিতে এবং সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য যুবকে একজন প্রশাসক নিয়োগের সুপারিশ করেছিল কমিশন।

এর আগে প্রথম কমিশন গঠন করা হয় ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি। সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিনকে চেয়ারম্যান করে কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়, যুবকের মোট গ্রাহক ২ লাখ ৬৭ হাজার ৩০০ জন। এসব গ্রাহক যুবকের কাছে পাওনা হচ্ছেন ২ হাজার ১৪৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। তবে যুবকের সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহকের দায়-দেনা পরিশোধ সম্ভব। এজন্য একজন প্রশাসক নিয়োগ করতে হবে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এ দুই কমিশনের সুপারিশও অন্ধকারে চলে গেছে।

এদিকে ‘যুবকে ক্ষতিগ্রস্ত জনকল্যাণ সোসাইটি’ পরিচালিত অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, সারা দেশে যুবকের সম্পত্তি রয়েছে ২২৬৮ একর। যার বর্তমান বাজারমূল্য ১০ হাজার কোটি টাকা। এগুলোর মধ্যে ৩৫টি জেলায় ১৮টি বাড়ি, ১০টি প্রকল্প ও ৭১ খণ্ড জমি রয়েছে। শুধু ৭১টি দাগে মোট জমির পরিমাণ ২ হাজার ২৬৮ একর। এছাড়া ঢাকাসহ দেশব্যাপী ২০টি বাড়ি ও জমির পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৬১৭ শতাংশ। এর মধ্যে পুরানা পল্টন বি কে টাওয়ার (১৮.১৫ শতাংশ), ধানমন্ডির বাড়ি (৩৩.৫২ শতাংশ), কাঁচপুরে শিল্প প্লট (৮৭৮ শতাংশ), কক্সবাজার সেন্টমার্টিনে হোটেল (৭৬৯ শতাংশ) রয়েছে। পাশাপাশি ফেনীতে অ্যাপার্টমেন্ট (৩৬ শতাংশ), খুলনা (৩৩ শতাংশ) ও বরগুনায় (৫১.৫ শতাংশ) বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। আর বরিশাল শায়েস্তবাদে ভবন (৪১ শতাংশ), বরিশাল হেমায়েত উদ্দিন রোডে ভেনাস শপিং সেন্টার (১৮.৫ শতাংশ) রয়েছে। এছাড়া কুয়াকাটা (৫৯৯ শতাংশ), বাউফল (২১ শতাংশ), ঢাকার পল্টন (২১.৫ শতাংশ) ও চাঁদপুরে (৩০ শতাংশ) একটি করে বাড়ি রয়েছে। আরও আছে-গ্রিনফিল্ড ফোন টাওয়ার সারা দেশে (৫০৮ শতাংশ), লামা রাবার শিল্প (১ লাখ ৬০ হাজার শতাংশ) এবং বাগেরহাটে জে কে হ্যাচারি অ্যান্ড নার্সারি লি. (৪৫০০ শতাংশ)। প্রকল্পভিত্তিক জমির পরিমাণ সাড়ে চার লাখ শতাংশ।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৪ সালে সদস্যদের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের মধ্য দিয়ে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি (যুবক) কার্যক্রম শুরু করে। জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে নিবন্ধন নিয়ে প্রায় ২০ ধরনের ব্যবসা শুরু করে। ২০০৬ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পৃথক তদন্তে গ্রাহকদের প্রতারণার ঘটনা বেরিয়ে আসে। ওই সময় যুবকের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে আসে। পরে ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

শেয়ার করুন