সম্প্রতি পোশাকশিল্প নিয়ে যারা ভাবেন ও গবেষণা করেন, এমন কতিপয় অভিজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে এই শিল্পের মূল অগ্রাধিকারগুলো নিয়ে আলাপ-জালোচনা করার সুযোগ লাভ করেছি। তারা এই শিল্পকে স্বাভাবিক গতিধারায় ফিরিয়ে আনা এবং নিকট ভবিষ্যতে বিশ্বে শীর্ষস্থান অর্জনের জন্য এর প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। বৈশ্বিক ফ্যাশন বাজারে নেতৃত্ব প্রদানে আমাদের আরো বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে মনোযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।
বিশেষ করে এই মুহূর্তে কাস্টমস প্রক্রিয়াগুলো সহজীকরণ করা দরকার। প্রতিযোগিতায় আরো সক্ষমতা অর্জনের জন্য পণ্য খালাসের সময়সীমা ১০-১৫ দিন থেকে কমিয়ে আনা অত্যাবশ্যক। শনিবারসহ সপ্তাহে ছয় দিন শুল্ক কার্যক্রম চালু রাখা হলে এবং কায়িক পদ্ধতিতে বিরাজমান প্রতিবন্ধকতাগুলো কমিয়ে ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রবর্তন বরা হলে দক্ষতা বাড়বে। গাজীপুরের মতো শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে পণ্য পরিবহনে অহেতুক সমক্ষেপণ কমাতে এবং সময়মতো ডেলিভারি নিশ্চিত করার জন্য সড়কগুলোর সংস্কার ও উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত বন্দর সুবিধা এবং নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহসহ সামগ্রিক লজিস্টিক অবকাঠাময় খাতে উন্নয়ন করা দরকার। এতে পোশাকশিল্পের আমদানি-রপ্তানিসহ সকল কার্যক্রম নির্বিঘ্নভাবে সম্পাদন করা সহজ হবে।
এই শিল্পে আমাদের অটোমেশন ও ডিজিটালাজেশন বাবদ বিনিয়োগ বাড়াতে হবে৷ আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি ও ডিজিটাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমগুলো গ্রহণ করে উৎপাদন দক্ষতা বাড়ানো যেতে পারে। কায়িক শ্রমের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করা যেতে পারে। এই শিল্পকে তা উচ্চ মূল্য সংযোজিত পল্য উৎপাদনে রূপান্তরিত হতে সহায়তা করতে পারে। প্রবৃদ্ধির সহায়তার জন্য পরিবহন নেটওয়ার্ক ও জ্বালানি সরবরাহের মতো অবকাঠানোগুলোর ক্রমাগত উন্নয়ন অপরিহার্য। টেকসই জ্বালানি সমাধানে বিনিয়োগ করা ও বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধার আধুনিকীকরণ দীর্ঘমেয়াদি প্রতিযোগিতায় অবদান রাখতে পারে।
কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নের ওপরও আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে ভাষা, যোগাযোগ ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়ানো গেলে তা একদিকে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করবে, অন্যদিকে এ ক্ষেত্রগুলোতে বিদেশি নাগরিকদের ওপর শিল্পের নির্ভরশীলতা হাস পাবে। ফলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। এছাড়া নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং ন্যয্য মজুরি, সুবিধা ও সুরক্ষার মাধ্যমে কর্মীদের কল্যাণ বাড়ানো খুবই গুরুতপূর্ণ বিষয়। কর্মীদের অধিকারগুলো সমুন্নত রাখা এবং কারখানা ব্যবস্থাপনা ও ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে নিয়মিত সংলাপের ব্যবস্থা থাকলে তা একটি স্থিতিশীল ও অনুপ্রাণিত কর্মীবাহিনী বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
এই শিল্পে পণ্যের অফারে বৈচিত্র্য আনতে হবে। স্পোর্টসওয়্যার, টেকনিক্যাল অ্যাপারেল ও বিশেষায়িত পোশাকের মতো উচ্চমূল্যের পণ্যের ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর গতানুগতিক স্বল্পমূল্যের পণ্য উৎপাদনের ওপর শিল্পের নির্ভরতা কমিয়ে দেবে। ফেব্রিক ও উপকরণে উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিতে হবে। রপ্তানি পণ্য পরিবেশবান্ধব ও টেকসই ফেবিক্সের ব্যবহার শুধু বৈশ্বিক মানই পূরণ করবে না, বরং বৈশ্বিক ফ্যাশন বাজারে টেকসই পোশাকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে সহায়তা করবে। এজন্য সুশাসন ও সরকরি নীতিসহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। এই শিল্পের প্রবৃদ্ধির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও একটি নিরপেক্ষ ব্যবসায়িক পরিবেশ অপরিহার্য। শিল্পের জন্য দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও সহায়তা নিশ্চিত করতে ব্যাংক, শুল্ক ও কর বিভাগে সংস্কার আনাও প্রয়োজন। এছাড়া বৈশ্বিক মানের সঙ্গে সংগতি রেখে কমপ্লায়েন্স প্রতিপালন করতে হবে। বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য উৎপাদন, শ্রম অধিকার ও পরিবেশগত সাসাটেইনেবিলিটি প্রভৃতি ক্ষেত্রে আন্তর্জতিক মান বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত়পূর্ণ।