১০ মার্চ ২০২৫, সোমবার, ০২:১৩:৫৫ অপরাহ্ন
ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান
  • আপডেট করা হয়েছে : ১০-০৩-২০২৫
ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান

মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন নিতে চেনে মে হয়েছে। বিশেষ করে ২০ জানুয়ারি তার অভিষেকের পর থেকেই এই বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে আন্তর্জতিক অঙ্গণে। নির্বাচনের আগে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন-গাজা যুদ্ধ বন্ধ করবেন এবং সে পথেই এগুচ্ছে সব। ইতিমধ্যে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে এবং সেখানে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির চেষ্টা চলছে। যাদিও মাঝে ট্রাম্পের গাজাবাসীদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাবে জল অনেকটা ঘোলা হয়েছিল। তারপরও সংকট সমাধানের পথ অনেকাংশে মসৃণ হয়েছে। বাকি রইল ইউক্রেন তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে কথাও বলেছেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে রীতিমতো বাধ্য করানো হচ্ছে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য। 


সম্প্রতি হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের সঙ্গে জেলেনস্কির বৈঠক হয়েছে সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, আপনি লাখ লাখ লোকের জীবন নিয়ে জুয়া খেলছেন। আপনি বিশ্বকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। আপনি এমনটি করতে পারেন না। আপনাকে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। দুজনের মধ্যে এই বাগবিতণ্ডা সেদিন সারা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছিল। এ থেকে এটাই প্রতীয়মান যে, জেলেনস্কিকে যুদ্ধ বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। যদিও কেউ কেউ বলছেন, পুরোটাই পরিকল্পিত খেলা। এক ধরনের রাজনৈতিক ছিনতাই। জেলেনস্কিকে ব্যর্থ প্রমাণ করে তাকে সরিয়ে দিতেই ওভাল অফিসের এই চাতুরতা, যাতে পরবর্তী আলোচনা আরো সহজতর হয়। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, যে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া ছিল চিরশত্রু তাদের এখন একে অপরের মাঝে নরম সুরে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। ইউক্রেন ইস্যুতে দুই পরাশক্তি যেন একপথে মিলিত হচ্ছে। যদিও বিশ্ব শান্তির জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প হতে পারে না। স্নায়ু যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্ক ছিল ব্রেডের উভয় পার্শ্বের ধারের মতো। কোনো দিক থেকেই বন্ধুত্বের পথ খোলা ছিল না। সেই রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন নতুন মোড়কে স্থান পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, রাশিয়ার ওপর থেকে বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা শিখিল করার চিন্তাভাবনাও চলছে। 


মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন ও ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করার মানসিকতা থেকেই এই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে হোয়াইট অউজ পররাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে একটি তালিকা প্রস্তুত করতে বালছে। ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে মস্কোর কূটনৈতিক ও অর্থ অর্থনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নের বিস্তৃত আলোচনার অংশ হিসেবে আগামী দিনগুলোতে এসব বিষয়ে রুশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা হবে বলে কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে। নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত দপ্তরগুলো এখন নির্দিষ্ট কিছু সংস্থা ও ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের প্রস্তাব তৈরি করছে, যার মধ্যে কয়েক জন রুশ অলিগার্কও (ক্ষমতশালী ও সম্পদশালী। রয়েছেন। ওয়াশিংটন কীসের বিনিময়ে রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি দিতে পারে, সে বিষয়টি এখনো সুষ্পষ্ট নয়। তবে রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল উৎপাদনকারী দেশ। যুক্তরাষ্ট্র যদি রাশিয়ার জ্বালানি খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে, তাহলে ইরান থেকে তেল রপ্তানির ওপর ট্রাম্প কঠোর পদক্ষেপ নিলে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়ার সম্ভাবনা হ্রাস পেতে পারে।

 

ক্রেমলিন গত বছর বলেছিল, ডেমোত্রনাট প্রেসিডেন্ট জে বাইডেনের প্রশাসনের অধীনে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক 'শূন্যের নিচে' নেমে গেছে। বাইডেন ইউক্রেনকে সাহায্য ও অস্ত্র সরবরাহ করেছিলেন এবং ২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণের শাস্তি হিসেবে মস্কোর বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। তবে যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের নীতি দ্রুত বদলেছেন এবং মস্কোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। গত ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ফোন করেন এবং এর পরপরই সৌদি আরব ও তুরস্কে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জানুয়ারিতে ট্রাম্প হুমকি দিয়েছিলেন, যদি পুতিন যুদ্ধবিরতির বিষয়ে আলোচনায় অগ্রগ্রহী না হন, তাহলে তিনি রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরো কঠোর করবেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তার প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিলের সম্ভাবনার কথা স্বীকার করেছেন। 


এবার আসা যাক চীন প্রসঙ্গে। দেশটি একটি অর্থনৈতিক পরাশক্তি হলেও নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে নেই। চীন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধ থাকলেও সেটা বেশির ভাগই অর্থনৈতিক। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে বাণিজ্য যুদ্ধও কম হয়নি। তবে এটি শুধু চীনের বেলায় নয়, মেক্সিকো, কানাডা, ভারতের পর ইইউর ওপরেও হয়েছে। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইইউর দূরত্বও কম বাড়েনি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে ট্রাম্প বলেছিলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলতে কী দারুণ শোনায়। ইউরোপীয় সব ছোট দেশ যার ঐক্যবদ্ধ... তারা আমাদের গাড়ি নেয় না। তারা আমাদের খামারের পণ্য নেয় না। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লাখ লাখ গাড়ি বিক্রি করে। কিন্তু তারা শুষ্ক দেয় না। এটা হতে পারে না। তাদেরকেও বাড়তি শুল্ক দিতে হবে। তবে চীনের সঙ্গে তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ রয়েছে। চীন মনে করে, তাইওয়ানকে উসকানি দিচ্ছে পশ্চিমা শক্তি, যাতে করে দ্বীপটি স্বাধীনতার দিকে ধাবিত হয়। চীনের বক্তব্য, তাইওয়ান তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ, একে কেউ আলাদা করলে তার ফল ভালো হবে না। 


ট্রাম্পের এই ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিশ্ব যেন এক নতুন ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বহুমেরুর বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে, পরাশক্তি হিসেবে ছিল ইউরোপের কয়েকটি দেশ, প্রভাব কড়ছিল আটলান্টিক। পাড়ের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির মাধ্যমে একটি দ্বিমেরুর বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আবির্ভূত হয় বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে। অর্ধশতাব্দীব্যাপী এই দুই পরাশক্তির মধ্যে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা চলে, যেটি পরিচিতি পায় স্নায়ুযুদ্ধ হিসেবে। দুই পরাশক্তির এই স্নায়ুযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পেছনে কাজ করে অনেক প্রভাবক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বন্দ্বের মুল কারখটা ছিল আদর্শিক। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে স্বাধীনতা অর্জন করে যুক্তরাষ্ট্র, শাসনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করে গণতন্ত্রকে। এরপর নিরবচ্ছিন্নভাবে গণতন্ত্র চর্চা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী হয়েছে গণতন্ত্রের ধারক হিসেবে। অন্যদিকে, ১৯১৭ সালে বিপ্লবের মাধ্যমে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নও চেষ্টা করে কমিউনিজমকে বিভিন্ন দেশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে। ফলে, আদর্শিকভাবে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায় গণতন্ত্র ও কমিউনিজম, শুরু হয় স্নায়ুযুদ্ধ।

 

ট্রাম্পের বর্তমান অবস্থানকে মার্কিনীরা কিন্তু ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে। কারণ তার 'মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন' এই থিওরি তাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তারা মনে করেন, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভালো, বিশ্বশান্তির জন্য হিতকর। সর্বশেষ কংগ্রেসের ভাষণেও ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের পুনরুত্থানের ঘোষণা দিয়েছেন। এর আগে তিনি যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন তখন সিরিয়ায় যুদ্ধ চলছিল। ক্ষমতায় আসার পূর্বে তিনি বলেছিলেন, যুদ্ধ বন্ধ করার পদক্ষেপ পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতায় আসার পরই সিরিয়ার শায়রাত বিমান ঘাঁটিতে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর নির্দেশ দেন। এরপর থেকেই কথা উঠছিল যে, ট্রাম্প কি উলটো পথে হাঁটবেন? বিশ্বব্যবস্থায় কি 'ট্রাম্প ডকট্রিন' কার্যকর হবে? যদিও এবারের প্রেক্ষাপট একদম ভিন্ন। এবার তিনি গাজা ও ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের উদ্দ্যোগ নিয়েছেন এবং সে অনুযায়ী সবকিছু এগুচ্ছে। তবে ইউরোপের সঙ্গে দূরত্ব কিছুটা বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সহায়তা দিতে পিছু হটলে ইইউ নেতারা কিয়েডের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পাশাপাশি ইইউ তাদের সদস্য দেশসমূহের নিরাপর নিশ্চিতে প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়াতে সম্মত হয়েছে


শেয়ার করুন