১৭ মার্চ ২০২৫, সোমবার, ০৫:২১:৫৭ পূর্বাহ্ন
বেলুচিস্তান নিয়ে জিন্নাহ কি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন?
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৬-০৩-২০২৫
বেলুচিস্তান নিয়ে জিন্নাহ কি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন?

ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার পর ২২৭ দিন পর্যন্ত একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র ছিল স্টেট অফ কালাত বা বেলুচিস্তান। তারা পাকিস্তানের অংশ হতে চায়নি এবং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহও সেই সময় তাতে সায় দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশদের চলে যাওয়ার পর ভারত বা পাকিস্তানে স্বতন্ত্র শাসক রাজাদের শাসনে থাকা রাজ্যগুলোর পক্ষে স্বাধীন থাকা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।


বেলুচিস্তানের একটা বিশাল অংশ শীতল মরুভূমি, যা ইরানি মালভূমির পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত। 


বর্তমানে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশ, ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশ এবং আফগানিস্তানের একটি ছোট অংশে বিভক্ত প্রাচীন বেলুচিস্তান। আফগানিস্তানের নিমরুজ, হেলমান্দ ও কান্দাহারও আগে বেলুচিস্তানের অংশ ছিল।


বালোচরা সুন্নি মুসলমান। এমনকি শিয়া অধ্যুষিত ইরানের সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশেও বালোচ সুন্নি মুসলমানদের বাস রয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বেলুচিস্তানে বিদ্রোহের সুর উঠতে থাকে। সেখানে চীনের প্রবেশের পর থেকে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। 


পাকিস্তান চীনকে বেলুচিস্তানের গোয়াদর বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার পর থেকেই স্থানীয় বালুচরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছে। 


বেলুচিস্তান বরাবরই পারস্য ও ভারতীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে 'স্যান্ডউইচ'-এর মতো একটি অবস্থানে ছিল। এমনকি উত্তরের প্রতিবেশী আফগানিস্তানকেও এই দুই সাম্রাজ্যে ঘটা যুদ্ধের প্রভাব বইতে হয়েছে। তবে আফগানিস্তানের মতো আত্মরক্ষার প্রাচীর হিসেবে পাহাড় নেই বেলুচিস্তানের।


প্রসঙ্গত, কালাতকে অনেকেই পাকিস্তানের হায়দ্রাবাদ বলে আখ্যা দিতেন। কালাত একটা স্বাধীন দেশীয় রাজ্য ছিল যা পাকিস্তানের অংশ হিসেবে সে দেশের সঙ্গে যোগ দিতে রাজি হয়নি। এদিকে হায়দ্রাবাদও ভারতে যোগ দিতে অস্বীকার করেছিল।


অনেকেই দাবি করেন, ভারতের সঙ্গে যোগ দিতে চেয়েছিলেন কালাতের খান। কিন্তু জওহরলাল নেহরু সে বিষয়ে সম্মত হননি।


অনেক ইতিহাসবিদ আবার এই তত্ত্বের বিরোধিতা করে জানিয়েছেন, এর নেপথ্যে কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। তাদের মতে, কোনো দেশেরই অন্তর্ভুক্ত হতে না চাওয়া কালাত নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চেয়েছিল। 


স্বাধীন বেলুচিস্তানের সমর্থন করেছিলেন জিন্নাহ


মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ কালাত ও হায়দ্রাবাদকে আইনি পরামর্শ দিয়ে জানিয়েছিলেন, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পরেও তারা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে থাকতে পারে।


কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই কোনোরকম সমঝোতা সম্ভব হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সামরিক অভিযানের পর ভারতের অংশ হয় হায়দ্রাবাদ। 


জার্মান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মার্টিন এক্সম্যান বালোচ জাতীয়তাবাদ এবং তার ইতিহাস নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন, যার নাম 'ব্যাক টু দ্য ফিউচার: দ্য খানেইতস অফ কালাত অ্যান্ড দ্য জেনেসিস অফ বালোচ ন্যাশনালিজম ১৯১৫-১৯৫৫'। 


এই বইয়ে মার্টিন এক্সম্যান লিখেছেন, কালাতের বিষয়ে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর পরামর্শ ব্রিটিশ শাসকদের বিস্মিত করেছিল। তবে কালাত কিন্তু হায়দ্রাবাদের মতো ছিল না।


এক্সম্যান লিখেছেন, ১৯৪৮ সালের ২০ মার্চ কালাতের খান (শাসক) পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার বিষয়ে সম্মতি জানান। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব থাকায় ভারত এবং আফগানিস্তানের সাহায্য আশা করেছিলেন কালাতের খান।


পাকিস্তানি ইতিহাসবিদ ইয়াকুব খান বাঙ্গাশ তার 'এ প্রিন্সলি অ্যাফেয়ার' বইয়ে লিখেছেন, কালাত পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার আগে থেকেই সেখানে গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হচ্ছিল।


"কালাত স্টেট ন্যাশনাল পার্টি (কেএসএনপি) ১৯৪৫ সালে জওহরলাল নেহেরুর সভাপতিত্বে অল ইন্ডিয়া স্টেট পিপলস কনফারেন্সেও অংশ নিয়েছিল। অন্যদিকে, বালুচিস্তানে কিন্তু মুসলিম লীগ কখনোই সমর্থন পায়নি।" 


কালাত কী চেয়েছিল?


ইতিহাসবিদ ইয়াকুব খান বাঙ্গাশ লিখেছেন, কালাতের খান এবং কেএসএনপি মতাদর্শগতভাবে গণতান্ত্রিক ছিল। জাতীয়তাবাদী হওয়ায় কেএসএনপি মুসলিম লীগের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানে যোগ দিতে চায়নি। কেএসএনপি ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে চেয়েছিল বা কালাতের খানের সঙ্গে থেকেই একটা স্বাধীন রাষ্ট্র চেয়েছিল।


"কালাতের খান গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন করতেন এবং এর অধীনে সেখানে দুই কক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থাও গঠন করা হয়েছিল। কালাতের সংসদ মনে করত শুধু মুসলমান হওয়ার কারণেই বালোচদের পাকিস্তানের অংশ হওয়া উচিত নয়। কিন্তু তাদের এই প্রতিরোধ পাকিস্তান সরকার চূর্ণ করে দেয় এবং জোর করে কালাত দখল করে তারা।"


শেয়ার করুন