২৬ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার, ০৫:৫০:২৮ অপরাহ্ন
রপ্তানি, প্রবাসী আয় ও রিজার্ভে স্বস্তি সত্ত্বেও গরিব বাড়বে?
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৬-০৪-২০২৫
রপ্তানি, প্রবাসী আয় ও রিজার্ভে স্বস্তি সত্ত্বেও গরিব বাড়বে?

বাংলাদেশে রপ্তানি আয় বাড়ছে, প্রবাসী আয়ও বাড়ছে। রিজার্ভের অবস্থাও ভালো। তারপরও বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে দারিদ্র্য বাড়বে, প্রবৃদ্ধি কমবে। অর্থনীতির এই বিপরীত চিত্র কেন? সমস্যা কোথায়? 


বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে চলতি বছরে আরও ৩০ লাখ মানুষ ‘অতি গরিব' হবে। তখন অতি দারিদ্র্যের হার ৭.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯.৩ শতাংশ হবে। 


জাতীয় দারিদ্র্য হার গত বছরে ছিল সাড়ে ২০ শতাংশ, ২০২৫ সালে তা বেড়ে ২২.৯ শতাংশ হবে। 


২০২২ সালের জনশুমারি অনুসারে, দেশের সংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। বিশ্বব্যাংকের হিসাবটি বিবেচনায় আনলে ২০২৫ সাল শেষে অতি গরিব মানুষের সংখ্যা হবে এক কোটি ৫৮ লাখের মতো। অন্যদিকে জাতীয় দারিদ্র্য হার বা গরিব মানুষের সংখ্যা হবে তিন কোটি ৯০ লাখের মতো।  


বিশ্বব্যাংক এই হিসাব করতে গিয়ে দেশের মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়াকে প্রধান কারণ হিসাবে বিবেচনায় নিয়েছে। তারা এর সঙ্গে দুর্বল শ্রমবাজার ও অর্থনৈতিক শ্লথগতির কথাও বলছে তারা। 


আর বিশ্বব্যাংকের মতে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)-র প্রবৃদ্ধি ৩.৩ শতাংশ হতে পারে। গত জানুয়ারি মাসে তারা বলেছিল ৪.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। তবে আগামী অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে ৪.৯ শতাংশ হতে পারে। চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ হতে পারে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক।


বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজারের কথায়, এখনই সময় নির্দিষ্ট কিছু সংস্কারের দিকে মনোযোগ দেওয়ার, যাতে অর্থনীতির সহনশীলতা বাড়ে, প্রবৃদ্ধি জোরদার হয় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। বাণিজ্য আরও উন্মুক্ত করতে হবে, কৃষি খাতে আধুনিকায়ন আনতে হবে এবং বেসরকারি খাতে গতি আনতে হবে।  


কিন্তু বাংলাদেশে রপ্তানি আয় বাড়ছে। ২০২৫ সালের মার্চ মাসেই বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিল ৪.২৫ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪ সালের মার্চ মাসের ৩.৮১ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ১১.৪৪ শতাংশ বৃদ্ধি। 


জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মার্চ মাসে রপ্তানি গত বছরের একই মাসের তুলনায় ১১.৪৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৪.২৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।


২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) বাংলাদেশ রপ্তানি খাতে উন্নতি করেছে। মোট রপ্তানি আয় হয়েছে ৩৭.১৯ বিলিয়ন ডলার, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ের ৩৩.৬১ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ১০.৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি।


২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত তৈরি পোশাক খাত থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩০.২৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০.৮৪ শতাংশ বেশি।


প্রবাসী আয় বেড়েছে। মার্চে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় এসেছে ৩.২৯ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের মার্চে এসেছিল ১.৯৯ বিলিয়ন ডলার। আগের বছরের মার্চের তুলনায় এবার একই মাসে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি ৬৪ শতাংশ। এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রবাসী আয় এসেছিল ২.৫২ বিলিয়ন ডলার। 


রিজার্ভও বাড়ছে। মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মোট (মজুত) রিজার্ভ ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬.৩৯ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফ-এর হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, রিজার্ভ বেড়ে হয়েছে ২১.১১ বিলিয়ন ডলার।


এমন পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কেন কমবে? আর কেনইবা বাড়বে অতি গরিব মানুষের সংখ্যা? 


এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম বলেন, দেশের ভিতরে উৎপাদন বাড়ছে না। আর মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের চাহিদা বাড়ছে না। উৎপাদন না বাড়া মানে হলো বিনিয়োগ বাড়ছে না। আর বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং উচ্চ ব্যাংক সুদ হারের কারণে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ হচ্ছে না। বাড়ছে না বিদেশি বিনিয়োগ।


'রিজার্ভ বাড়ছে, রপ্তানি বাড়ছে, রেমিট্যান্স বাড়ছে। এগুলো দিয়ে তো আর বিনিয়োগ হয় না। বিনিয়োগ না বাড়লে উৎপাদন বাড়ে না, কর্মসংস্থান বাড়ে না। আয় বাড়ে না। আর মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে, ক্রয় ক্ষমতা কমছে। উৎপাদন না বাড়লে প্রবৃদ্ধিও বাড়ে না। সেখান থেকেই বিশ্বব্যাংক অতি গরিব মানুষের সংখ্যা বাড়া এবং প্রবৃদ্ধি কমার আশঙ্কা করেছে।' 


গত ছয় বছরের মধ্যে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে আছে। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রমিক আন্দোলন ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ না করায় চলতি অর্থবছর (২০২৪-২৫)-এর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমে ১০৪.৩৩ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বিনিয়োগ ছিল ৩৬০.৫ মিলিয়ন ডলার।


জুলাই-সেপ্টেম্বরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৭৬.৭৯ মিলিয়ন ডলার। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় তা ৪৬ শতাংশ কম। আমদানি কমেছে। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে আমদানির জন্য ১.৬৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়। আর ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে খোলা হয়েছে ১.১৫ বিলিয়ন ডলারের।


ব্যাংক থেকে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমেছে। বেড়েছে সরকারের ঋণ নেওয়া। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে গত ১০ মার্চ পর্যন্ত সরকার ৩৮ হাজার ৫১০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। গত জানুয়ারি পর্যন্ত যেখানে সরকারের ব্যাংক ঋণ ছিল ১৩ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। প্রথম সাত মাসে সরকার যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছিল, শেষ এক মাস ১০ দিনে নিয়েছে তার প্রায় দ্বিগুণ।


অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবির বলেন, রেমিট্যান্সের টাকা বিনিয়োগে আসে না। এটা অনেক লোক মিলে একটা বড় আয়। তারা এই অর্থ বাড়ি-ঘর ও ভোগে ব্যয় করে। আবার রিজার্ভের টাকা দিয়েও বিনিয়োগ হয় না। ওটা আমদানি ব্যয় মিটাতে চলে যায়। আর এখন ব্যাংক ছাড়া শেয়ার বাজার থেকে বিনিয়োগের অর্থ আসছে না। শেয়ার বাজারের অবস্থা খারাপ। আর ব্যাংকের উচ্চ সুদ হার বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করছে। কিন্তু বিনিয়োগ না বাড়লে তো আর প্রবৃদ্ধি বাড়ে না, কর্মসংস্থান হয় না। দারিদ্র্য কমে না।


তার কথায়, ব্যবসায়ীদের আস্থার মধ্যে নিয়ে আসা দরকার। সরকারের ধারিবাহিকতা ও স্থিতিশীলতা থাকলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা পায় না। আর রাজনৈতিক সরকার ছাড়া বিদেশিরা বিনিয়োগ করতে চায় না। তারা চায় নিরাপত্তা নিশ্চয়তা। অর্থনীতির যা অবস্থা তাকে আমরা একটা বদ্ধ পরিস্থিতি বলতে পারি আমরা।


এই পরিস্থিতি কাটাতে না পারলে মন্দার আশঙ্কা করছি। আর তিন মাস পর ট্রাম্পের শুল্ক নীতি শেষ পর্যন্ত কী হয় তা-ও দেখার আছে, বলেন অধ্যাপক আইনুল ইসলাম। 


শেয়ার করুন