২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৮:৪৬:৫৬ অপরাহ্ন
দেশে বাড়ছে কম বয়সী হার্টের রোগী
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-০৯-২০২২
দেশে বাড়ছে কম বয়সী হার্টের রোগী

বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে হৃদরোগে। দেশের পরিস্থিতিও একই। প্রতি বছর দেশে ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষের প্রাণ যায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। চিকিৎসকরা বলছেন, এর প্রধান কারণ তামাক সেবন ও উচ্চ রক্তচাপ। তারা বলছেন, দেশে প্রতি পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজনের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। একই ভাবে তামাক সেবনও উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।


বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, হৃদরোগের পেছনে যতগুলো কারণ রয়েছে তার অনেকগুলোই আমাদের জীবনাচরণজনিত। যেমন: তামাক সেবন, কায়িক শ্রমের অভাব, সুষম খাদ্য গ্রহণে অসেচতনতা, অতিরিক্ত লবণ ও চিনি জাতীয় খাবার গ্রহণ। এর পাশাপাশি পরিবেশ, বিশেষ করে বায়ুদূষণ ও হৃদরোগের অন্যতম কারণ।


এমন প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব হার্ট বা হৃদরোগ দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য, ‘ইউজ হার্ট ফর এভরি হার্ট’।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে ১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। যার দুই-তৃতীয়াংশের বাস বাংলাদেশসহ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করা না হলে বুকে ব্যথা বা অ্যানজাইনা, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইলিউর এবং হার্ট বিট অনিয়মিত হওয়ার শঙ্কা থাকে। আশঙ্কার বিষয় হলো, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে তরুণদের মধ্যেও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার উচ্চ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাতে অকাল মৃত্যু বাড়ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশব্যাপী হার্ট অ্যাটাক ও উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ে গণসচেতনতা তৈরি জরুরি হয়ে পড়ছে।


জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিউট হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন জানান, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন ৭০০ থেকে এক হাজার মানুষ সেবা নিতে আসেন। তাদের মধ্যে দুশ থেকে তিনশ জনকে ভর্তি নেওয়া হয়। ১২৫০ শয্যার হাসপাতালটিতে ১২০০ থেকে ১৪০০ রোগী সব সময় ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।


তিনি আরও বলেন, এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই হৃদরোগীদের উপচেপড়া ভিড়। প্রথমে ৩১৪ শয্যা ছিল। সেটি বাড়িয়ে ৪৫০ শয্যা করা হয়। কিন্তু রোগীর তুলনায় এই সংখ্যা একেবারেই কম হওয়ায় ২০২১ সালের মার্চে ১২৫০ শয্যায় উন্নিত করা হয়েছে। এরপরও স্থান সংকুলান হচ্ছে না। হৃদরোগের কারণ চিহ্নিত করে সেটি প্রতিরোধে জোর দিতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে হৃদরোগে আক্রান্ত ও মৃত্যু মহামারি আকারে দেখা দিতে পারে।


ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটিতে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের মে, ২০২১ থেকে জুলাই, ২০২২ পর্যন্ত ২৩ হাজার ৯৭০টি এনজিওগ্রাম ও এনজিওপ্লাস্টি হয়েছে। আর হার্ট সার্জারি হয়েছে ৩ হাজার ৪০৯টি। এর মধ্যে ওপেন হার্ট সার্জারি ১ হাজার ৭৯টি।




বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কম বয়সে হার্টের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গবেষণা অনুযায়ী, উন্নত বিশ্বের তুলনায় এই হার ১৭ গুণের বেশি। এর অন্যতম কারণ, অল্প বয়সে ধুমপান, মদ্যপান, জাঙ্ক ফুড, লাইফ স্টাইল, অল্প বয়সে ডায়াবেটিস হওয়া।


তিনি বলেন, সাধারণত ৬০ বছর বয়স থেকে প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ৩৫ বছরের কম বয়সী অসংখ্য ব্যক্তির হার্ট অ্যাটাক হয়ে হচ্ছে। ফলে অপরিণত বয়সে মৃত্যুও বাড়ছে।


বিশেষজ্ঞরা জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতি বছর বিশ্বে ১৯ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশেও প্রতি বছর ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগে মারা যায়। যার ২৪ শতাংশের জন্য দায়ী তামাক।


গ্লোবাল বারডেন অফ ডিজিজ স্টাডি (জিবিডি) ২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের প্রধান চারটি কারণের একটি তামাক। বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারজনিত অসুখে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মারা যায়। বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ (৩ কোটি ৭৮ লাখ) তামাক ব্যবহার করছে। যা হৃদরোগ পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলছে।


এছাড়া হৃদরোগের অন্যতম কারণ খাবারে অতিরিক্ত লবণ থাকা। গবেষণায় প্রতি ১০০ গ্রাম খাবারে সর্বোচ্চ ৭৫০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণকে নিরাপদ মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে দেখা গেছে, বাজারে বহুল প্রচলিত ৬১ শতাংশ বিস্কুট, চিপস, চানাচুর, নুডলস, ইনস্ট্যান্ট স্যুপ, ঝালমুড়ি, আচার, চাটনি ইত্যাদি প্রক্রিয়াজাত খাবারে নিরাপদ মাত্রার চেয়ে বেশি লবণ রয়েছে। আর ৩৪ শতাংশ খাবারে নিরাপদ মাত্রার দ্বিগুণ অর্থাৎ দেড় গ্রামের বেশি লবণ পাওয়া গেছে।


ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, দেশে অসংক্রামক রোগ বেশি হচ্ছে। এরমধ্যে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও সেরিব্রো কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ, ক্যানসার, ডায়াবেটিস ও সিওপিডি বা দীর্ঘমেয়াদে শ্বাসকষ্ট রোগ বাড়ছে। দেশে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ অসংক্রামক রোগে মারা যায়। এরমধ্যে ২ লাখ ৭৭ হাজারই মারা যাচ্ছেন কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজে। এর মধ্যে ১৯ শতাংশ হচ্ছে অকাল মৃত্যু। সার্বিক বিবেচনায় তামাক সেবন ও উচ্চ রক্তচাপজনিত হৃদরোগ প্রতিরোধে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।

শেয়ার করুন