ভারতকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুবিধা প্রদান সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০১৮ সালে। ঢাকা-দিল্লীর মধ্যকার এ চুক্তির আওতায় এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে ট্রায়াল রান। পরীক্ষামূলকভাবে এ দুই বন্দর ব্যবহার করে সড়ক পথে পণ্য গেছে ভারতের ত্রিপুরা ও মেঘালয় রাজ্যে। এক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয়নি। এবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে স্থায়ী ট্রানজিটের আদেশ জারি হওয়ায় চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাত অঙ্গরাজ্যে পণ্য পরিবহন শুরু হবে বলে আশা করছেন বন্দরসংশ্লিষ্টরা। সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নও দেখা দিয়েছে, কতটা প্রস্তুত চট্টগ্রাম বন্দর? আর এ ট্রানজিটের ফলে কতটা লাভবান হবে বাংলাদেশ? তবে এর নেপথ্যে রয়েছে বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক বিশাল এক মহাপরিকল্পনা, যা নিয়ে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছে জাপান, বাংলাদেশ ও ভারত।
চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা এবং দক্ষতা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি। বেড়েছে পণ্য হ্যান্ডলিং ক্ষমতা এবং ইয়ার্ডের কন্টেনার ধারণক্ষমতা। প্রতিটি টার্মিনাল ও জেটিতে সংযোজিত হয়েছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, যা পণ্য ওঠানামার গতি বাড়িয়েছে। প্রতিবছর আমদানি রপ্তানি বৃদ্ধি পেতে থাকলেও সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে পাল্লা দিতে সক্ষম হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। ভারতের সাত অঙ্গরাজ্যের পণ্য যদি চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে পরিবাহিত হয় তাহলেও বন্দরকে বেগ পেতে হবে না বলে মনে করছেন দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, এখনই যে সক্ষমতা তা দিয়েই ট্রানজিট সেবা প্রদান করা সম্ভব। বন্দরের নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ফলে ভারতের রাজ্যগুলোর আমদানি বাড়তে থাকলে তা সামাল দেওয়া কঠিন হবে না।
ভূমিবদ্ধ হওয়ার কারণে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য মেঘালয়, ত্রিপুরা, মনিপুর, অসম, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম ও অরুণাচল প্রদেশ বন্দর সুবিধা থেকে বঞ্চিত। কলকাতা থেকে অনেক দূরে এ রাজ্যগুলোর অবস্থান। ফলে পণ্য পরিবহনে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘপথ, যাতে লেগে যায় কয়েক দিন। অথচ, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে আমদানির পণ্য ওইসব রাজ্যে নিয়ে যাওয়া সম্ভব স্বল্প সময়ে এবং অনেক কম খরচে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান বন্দর দিবসের অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ট্রানজিট সুবিধা প্রদানের জন্য বন্দর সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছে। এছাড়া মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর ও বন্দরের বে-টার্মিনাল হয়ে গেলে ভবিষ্যতে সক্ষমতা প্রায় চারগুণ হয়ে যাবে। তখন বাংলাদেশ আশপাশের অন্য দেশগুলোকে ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা প্রদান করতে পারবে। তিনি বলেন, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর এমনই হবে যে, এ বন্দরকে ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট হিসেবে ব্যবহার করতে সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাংয়ের চেয়ে খরচ কম পড়বে। ফলে পার্শ^বর্তী দেশগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছে।
বাংলাদেশের বন্দর সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গত কারণেই আলোচনায় আসছে এর ব্যবহার নিশ্চিত করার বিষয়টি। কেননা, বিদ্যমান বন্দর সুবিধা দিয়ে দেশের চাহিদা মিটছে। গভীর সমুদ্র বন্দরে আসবে বেশি পণ্য নিয়ে অনেক বড় জাহাজ। বন্দরের সক্ষমতা যদি আরও বেড়ে যায় তবে তার ব্যবহার নিশ্চিত করতে অন্য দেশকে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রদানের বিষয়টি অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত বলে মনে করেন শিপিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
অর্থনীতিবিদ ও শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা প্রদান শুধু বাংলাদেশের বন্দর হয়ে ওই দেশের পণ্য পরিবহনের মতো সাধারণ ঘটনা নয়। বরং বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে রয়েছে বিশাল এক পরিকল্পনা। জাপান সরকারের বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্টের (বিগ বি) আওতায় মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক শিল্পায়নের এক মহাপরিকল্পনা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশে শিল্প জোন গড়ে সেখানে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির পরিকল্পনা ভারতের সাত রাজ্য, ভুটান এবং নেপালে। সে জন্য জাপান সরকার এ অঞ্চলে সার্বিক পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন চায়।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা গত মাসে ভারত সফর করেছেন। সেখানে তিনি বঙ্গোপসাগর ঘিরে শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব তুলেছেন। ভারত সরকারও এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। এছাড়া ত্রিপুরার আগরতলায় ভারত, বাংলাদেশ এবং জাপানের দায়িত্বশীল উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠকও হয়েছে। সে বৈঠকেও এ পরিকল্পনাটি গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়।
বাংলাদেশের মহেশখালীর মাতারবাড়ি থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত পর্যন্ত যে উন্নয়নযজ্ঞ দৃশ্যমান, তা সেই বিগ বি ধারণার আলোকেই হচ্ছে। জাপান সরকার বাংলাদেশকে তিনটি প্রকল্পের জন্য ১২৭ কোটি মার্কিন ডলার অর্থায়ন করছে। এ তিন প্রকল্পের মধ্যে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর অন্যতম, যা ২০২৭ সালের মধ্যে চালু হওয়ার কথা। ভারতের সঙ্গেও জাপানের সম্পর্ক ভালো হওয়ায় মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে তেমন সন্দেহ, অবিশ্বাস বা প্রতিবন্ধকতা থাকবে না বলে মনে করছেন শিল্প খাতের উদ্যোক্তারা।