বাংলাদেশ সীমান্ত মালদহে দাঁড়িয়ে পানি নিয়ে ঢাকা ও দিল্লিকে বার্তা দিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঢাকাকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, পানি দিতে আপত্তি নেই। আর গঙ্গার বেহাল দশা নিয়ে দিল্লিকে সতর্ক করে করেছেন তিনি। মমতার এমন বক্তব্য শুনে দুই দেশের কূটনীতিকরা এর তাৎপর্য বের করার চেষ্টা করছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ভালোবাসার কারণে বাংলাদেশকে পানি দিতে আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তবে এজন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বকেয়া অর্থ দাবি করেছেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ‘পানি দিতে আপত্তি নেই’ কথাটি শুনে ঢাকা বেশ আগ্রহ নিয়ে তৎপরতা বাড়িয়েছে। হঠাৎ করে মমতার মুখে এমন কথা অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। বিশেষ করে বৃহস্পতিবার বিকালে মালদায় তৃণমূল কংগ্রেসের এক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক কী বলেছেন তার ভিডিও ক্লিপ সংগ্রহ করার জন্য ঢাকা থেকে কলকাতার বাংলাদেশ উপদূতাবাসকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যটি এমন সময় এসেছে- যখন তিস্তার পানিচুক্তি নিয়ে ঢাকা দিল্লি ও পশ্চিমবঙ্গের দিকে তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে আছে। আবার ‘শিরে সংক্রান্তির’ মতো বছর তিনেক পর বিদ্যমান ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গাচুক্তির কার্যকাল শেষ হবে। যেখানে নানা জটিলতায় তিস্তার পানি চুক্তি হচ্ছে না. সেখানে গঙ্গা চুক্তির নবীকরণ নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়ায় আগ মুহূর্তে মমতা ব্যানার্জির এমন মন্তব্যে ঢাকা ও দিল্লির কূটনীতিকদের মাঝে নতুন চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে।
তাদের মতে, মমতা ব্যানার্জি এমন মন্তব্য করে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন- সত্যিই তিনি ঢাকাকে পানি দিতে চান, নাকি ঢাকাকে পানি দেয়ার নাম করে দিল্লির কাছ থেকে পাওনা টাকা তুলতে চান; তা এখনো পরিষ্কার নয়। আবার তার এমন মন্তব্য ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোনো অঙ্ক কাজ করে কিনা- সেদিকটিও নজরে রেখেছেন কূটনীতিকরা। এনিয়ে ঢাকায় সরকারি সূত্র এখনই মুখ খুলতে চায়নি। তাদের মতে, মমতা ব্যনার্জি কেন এই কথা বললেন সেটি নিয়ে তারা কাজ করছেন। প্রকাশ্যে কিছু বলার মতো হলে ঠিক সময়ে বাংলাদেশ প্রতিক্রিয়া জানাবে।
তবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সি এম শফি সামী ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে গঙ্গার পানি চুক্তির সময় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে কি বলেছিল বা সে নিয়ে মমতা ব্যানার্জি কি বলেছেন তা আমাদের দেখার বিষয় নয়। এটা সম্পূর্ণই তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমরা মনে করি, আমাদের ন্যায্যদাবি অনুযায়ী ভাটির দেশ হিসেবে আমাদের পানি পাওয়া উচিত।
জানতে চাইলে কলকাতার সাংবাদিক সত্যজিৎ চক্রবর্তী ভোরের কাগজকে বলেন, গঙ্গার দুই পাড়ই ভাঙছে। এর রক্ষণাবেক্ষণে কোনো গরজ নেই। এমন পরিস্থিতিতে কৌশলে প্রশ্ন তুলে দিয়ে মমতা ব্যানার্জি হয়ত এটাই বলতে চেয়েছেন, অতীতের কোনো সরকারই নদী সংরক্ষণ ও পরিচর্যার ব্যবস্থা করেনি। বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশ সীমানার বিস্তীর্ণ অংশে নদী রয়েছে। সেক্ষেত্রে দুই দেশের সরকারের নদী পরিচর্যায় যে ভূমিকা নেয়ার কথা ছিল তা নেয়া হয়নি। এতে যেমন জটিলতা বেড়েছে; তেমনি সমস্যায় পড়েছে দুই দেশের সরকারও। পাশাপাশি নদী নিয়ে কূটনৈতিক স্তরে যে উদ্যোগ নেয়ার কথা ছিল তাতেও ঘাটতি রয়েছে। আর এখানেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী আলোচনাটি তুলেছেন। এখন এর তাৎপর্য কী তা নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে সামনে আসবে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার মালদায় এক সমাবেশে মমতা বলেন, বাংলাদেশকে পানি দিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি হাসিনাজিকে ব্যক্তিগতভাবে ভালোবাসি। মমতা প্রশ্ন তোলেন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ফারাক্কা চুক্তি বাবদ রাজ্য সরকারের প্রাপ্য টাকা কেন্দ্রীয় সরকার এখনো দেয়নি কেন?
বাংলাদেশকে পানি বণ্টনের বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করে মমতা বলেন, তুমি আমাদের জল বাংলাদেশকে দিলে, আমার তাতে আপত্তি নেই। হাসিনাজিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে ভালোবাসি। ঠিক আছে। কিন্তু তার পরিবর্তে কেন্দ্র আমাদের রাজ্য সরকারকে ৭০০ কোটি টাকা দেবে বলেছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত এক পয়সা দাওনি। বলতে বলতে আমার মুখ ব্যথা হয়ে গেছে। হয়তো কেউ ভাবতে পারে, আমি কেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছি না। কিন্তু আমি অন্তত ৫০ বার গেছি। হয়তো এত বার যাইনি, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর সাত-আটবার তো গেছিই।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবেগৌড়ার সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হয়। চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৬ সালে। চুক্তি নবায়নের দিনক্ষণ যত এগিয়ে আসছে, ফারাক্কা নিয়ে তত বেশি সরব হতে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে। কারণ, আগেরবার চুক্তির সময় ভারতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন এইচ ডি দেবেগৌড়ার সরকার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতিবসুকে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। বছর তিনেক পরে সেই চুক্তির নবীকরণ হলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত সরকারের যে চুক্তি হবে তাতে সঙ্গে থাকতে হবে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে। তার আগেই বৃহস্পতিবার পানি নিয়ে নতুন বার্তা দিলেন মমতা।
এদিন সমাবেশের আগে দুপুরে মালদহে প্রশাসনিক বৈঠকেও ফারাক্কা চুক্তির প্রসঙ্গ তোলেন মমতা। তিনি বলেন, এটি কেন্দ্রের সরকারের অধীনস্থ একটি বিষয়। ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্পের বিষয়টিও কেন্দ্রের। তারা ড্রেজিং পর্যন্ত করেনি। ফলে মানুষের খুব অসুবিধা হয়। কেন্দ্রীয় সরকার যখন বাংলাদেশের সঙ্গে ফারাক্কা চুক্তি করেছিল, আমরা তাদের জল দিয়েছিলাম। কেন্দ্রীয় সরকার তখন লিখিতভাবে চুক্তি করেছিল, পরিবর্তে আমাদের টাকা দেয়া হবে এবং সেটা আমাদের ফারাক্কাকে ভালো রাখবার জন্য। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা সেই ৭০০ কোটি টাকা পাইনি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, গঙ্গা নদীর ভাঙন ১০০ বছর ধরে চলছে। সবাই ক্ষমতায় এসেছে, চলেও গেছে। কিন্তু ভাঙন রোধে কেউ কিছুই করেনি। অথচ গঙ্গার ভাঙন বিষয়টি কেন্দ্রের সরকারের অধীনে, আমার অধীনে নয়। ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্পটিও কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে।