সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছে। এ অবস্থায় নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি বাড়ানোর কৌশল হিসেবে দলের নেতা-কর্মীদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে নমনীয় অবস্থান নিয়েছে আওয়ামী লীগ। সেই নমনীয়তাই ভোটের মাঠে নৌকার জন্য চ্যালেঞ্জ ডেকে আনবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যেসব এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক, সেখানে নৌকার বিরুদ্ধে স্থানীয় নেতারা ভোটে দাঁড়িয়েছেন। মনোনয়নবঞ্চিত বর্তমান এমপিদের পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের অনেক জনপ্রতিনিধিও পদত্যাগ করে ভোটের লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন। বিরোধপূর্ণ এলাকাগুলোয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিভক্ত হয়ে নৌকার প্রার্থীর বিপক্ষে কাজও শুরু করেছেন। কয়েকটি আসনে বর্তমান প্রার্থীর বিপক্ষে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিষোদ্গার করতেও দেখা যাচ্ছে। এমনকি পরস্পরকে প্রকাশ্যে হুমকি-ধমকি দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এ কারণে অনেক জায়গায় সহিংসতার আশঙ্কাও করা হচ্ছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের তৎপরতা যেভাবে বেড়েছে, তাতে এক-তৃতীয়াংশের বেশি সংসদীয় আসনে নৌকার প্রার্থীরা কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে পারেন বলে মাঠপর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে। সারা দেশ থেকে আজকের পত্রিকার প্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্যমতে, ১২৭টি আসনে নৌকার বিপরীতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়েছেন ১৭৮ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী, যাঁরা স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বেশ প্রভাবশালী। এই প্রার্থীরা নৌকাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন।
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সবচেয়ে বিরোধপূর্ণ অঞ্চলগুলোর একটি বরিশাল। বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। মেয়র থাকাকালে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সঙ্গে প্রকাশ্যে বিরোধে জড়ান সাদিক। তাঁর কারণে জেলার রাজনীতিতে অনেকটাই কোণঠাসা ছিলেন জাহিদ ফারুক। তবে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিরোধের কারণে গত জুন মাসে অনুষ্ঠিত সিটি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত হন সাদিক আবদুল্লাহ। মেয়র পদ হারিয়ে এমপি হওয়ার জন্য মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি। এতেও ব্যর্থ হয়ে বরিশাল-৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জাহিদ ফারুকের বিরুদ্ধে লড়ছেন তিনি। এর মধ্যে সাদিকের বিরুদ্ধে দ্বৈত নাগরিকত্বের অভিযোগ তুলে নির্বাচন কমিশনে আপিল করেছেন জাহিদ ফারুক। এই আপিলে প্রার্থিতা টিকে গেলে জাহিদ ফারুকের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবেন সাদিক।
ফরিদপুর জেলার চারটি সংসদীয় আসনের মধ্যে তিনটিতে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। এর মধ্যে গত দুই নির্বাচনে ফরিদপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী তথা যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন) কাছে পরাজিত হন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ। তিনি এখন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান। জাফর উল্যাহকে এবার চ্যালেঞ্জ জানাবেন নিক্সন চৌধুরী।
ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে শাহ্ মো. ইশতিয়াক আরিফ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ঝামেলা তো একটু আছেই। ঝামেলা নাই বললে ভুল বলা হবে। এখন আমরা কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। দলীয় পদপদবিতে থেকে যদি কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব।’
জেলা সদর নিয়ে নরসিংদী-১ আসন গঠিত। এই আসনে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশের সঙ্গে বর্তমান সংসদ সদস্য ও দলটির প্রার্থী নজরুল ইসলাম হিরু সম্পর্ক সাপে-নেউলে। নৌকাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান কামরুল। তিনি পৌর মেয়র নিহত লোকমান হোসেনের ছোট ভাই। কামরুলের সমর্থনে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা মতবিনিময় সভাও করেছেন। নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পীরজাদা মোহাম্মদ আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, যাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ মানুষের কাছে জনপ্রিয়। এতে দলীয় প্রার্থীর বিজয় আগের মতো সহজ হবে না।
নাটোর-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার। তিনিও শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আহাদ আলী সরকার বলেন, ‘নৌকার প্রার্থী (শফিকুল ইসলাম শিমুল) শক্তিশালী প্রার্থী। তবে কোনো শক্তি বা হুমকি আমাকে নির্বাচন থেকে সরাতে পারবে না।’
নোয়াখালী-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী জাহাঙ্গীর আলম। এখনো পদে আছেন দাবি করে স্থানীয় প্রশাসনকে ব্যবহার করে নৌকার কর্মী-সমর্থকদের চাপ সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে।
ময়মনসিংহ-৩ আসনে সর্বোচ্চ সাতজন স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে। এর মধ্যে নরসিংদী জেলা পাঁচটি আসনেই আওয়ামী লীগের দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। এর মধ্যে একটি ছাড়া বাকি চারটিতেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
গত ২৬ নভেম্বর ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। এতে বর্তমান সংসদ সদস্যদের ৭১ জন বাদ পড়েন। বাদ পড়া ২১ জন আবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বর্তমান এমপিদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যাঁরা টানা একাধিকবার দলীয় মনোনয়নে নির্বাচন করছেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দিক থেকে চ্যালেঞ্জের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, নির্বাচনকে জমানোর জন্যই প্রাথমিকভাবে দল থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। তবে ১৫ ডিসেম্বরের পর দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী, শরিকদের আসন ছাড়ের বিষয়ে আলোচনা হবে। তবে এখন পর্যন্ত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনী মাঠ থেকে তাঁদের ওঠানোর কোনো সিদ্ধান্ত নেই।