২২ নভেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ১২:৫৯:০২ পূর্বাহ্ন
জাতীয় সংসদ নির্বাচন: নজর এখন নয়াদিল্লিতে
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৮-০৬-২০২৩
জাতীয় সংসদ নির্বাচন: নজর এখন নয়াদিল্লিতে

বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এরই মধ্যে কথা বলে ফেলেছে কয়েকটি দেশ। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন এই সারিতে সামনে আছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র আবার শুধু কথা বলে ক্ষ্যান্ত দেয়নি। একটি পদক্ষেপও ঘোষণা করেছে ওয়াশিংটন—ভিসা নীতি। কিন্তু প্রতিবার ভোটের আগে যে দেশটির ভূমিকা সবার আগে আলোচনায় আসে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়, সেই ভারত এখন পর্যন্ত যেন একদম নীরব। ভোট ও রাজনীতি নিয়ে আগ্রহী দেশি-বিদেশি সবার নজর তাই এখন নয়াদিল্লির দিকে।


বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে গত ২৪ মে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ভোটে অনিয়ম ও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের তারা ভিসা দেবে না। আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমে এই নীতিকে স্বাগত জানালেও পরে বেশ জোরালো অবস্থান নিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। তারা বলছে, যুক্তরাষ্ট্র ভিসা না দিলে বা যুক্তরাষ্ট্রে না গেলে কি যায় আসে। সরকারের এই অবস্থানের প্রশংসা করেছে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীন। তারা জানিয়েও দিয়েছে এ সরকারের পাশে তারা আছে।


চীনের এমন প্রকাশ্য সমর্থনের ফলে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন আঞ্চলিক ভূরাজনীতির অন্যতম ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। এই ইস্যুতে বৈশ্বিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র, কিন্তু চীনের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের ভূমিকা কী হতে পারে—এমন আলোচনাও শুরু হয়েছে।


এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছ থেকে কোনো রকম সমর্থন চায় কি না, চাইলে তা কেমন হতে পারে, এমন প্রশ্ন উঠেছে দিল্লিতেই। গত শুক্রবার নয়াদিল্লিতে ‘দ্য ফরেন করেসপনডেন্টস ক্লাব অব সাউথ এশিয়া’ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কথা বলেন বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. মুস্তাফিজুর রহমান।


অনুষ্ঠানে ভারতীয় এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে হাইকমিশনার বলেছেন, চলমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অব্যাহত রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন চায়। এ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে বন্ধুদেশগুলো সমর্থন দেবে, এটাই আশা। ভারতের কাছ থেকেও একই ভূমিকা আশা করা যায়।


আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে বাংলাদেশ কোনো সহযোগিতা চাইবে কি না, এমন প্রশ্নে হাইকমিশনার বলেন, এটা নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া সামাল দেওয়ার সক্ষমতা বাড়াতে ভারতসহ কোনো দেশের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে কি না, তা তারা বুঝবে।


তবে আগামী নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা কী হবে, এ বিষয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক আটলান্টিক কাউন্সিলের সাউথ এশিয়া সেন্টারের সিনিয়র ফেলো অধ্যাপক আলী রীয়াজ মনে করেন, নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। এর পর থেকে এ নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা কী হবে, সেই আলোচনা সামনে চলে এসেছে।


আটলান্টিক কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে ১৫ জুন প্রকাশিত এক প্রবন্ধে অধ্যাপক রীয়াজ লিখেছেন, ২০২১ সালে র‍্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর বাংলাদেশ ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করাতে ভারতের সহযোগিতা চেয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ওই নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে আদৌ ভারতের সঙ্গে আলোচনা করেছিল কি না, সে বিষয়ে অনেকের সন্দেহ আছে। আবার বাংলাদেশের অনুরোধ পাওয়ার পর ভারত বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তুলেছে—এমন কোনো ইঙ্গিতও পাওয়া যায়নি।


২০২১ সালের ডিসেম্বরে মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘনের অভিযোগে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) সাবেক ও তৎকালীন সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। আর গত মে মাসে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ঘোষণা করেন ভিসা নীতি। এর পর থেকেই দেশটির ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলীয় কিছু কংগ্রেসম্যান জো বাইডেনের সরকারকে চাপে রেখেছে বাংলাদেশের নির্বাচন পরিস্থিতির ওপর কড়া নজরদারির জন্য। আর চীন ১৫ জুন মার্কিন সিদ্ধান্তগুলোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিক্রিয়ার প্রশংসা করে তাঁর সরকারের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেছে।


এই অবস্থায়, নতুন মার্কিন ভিসা নীতি ভারতের জন্য এক ‘জটিল পরিস্থিতি’ তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন আলী রীয়াজ। তিনি লিখেছেন, ভারতীয় কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে, দেশটি কি শেখ হাসিনার সরকারকে ‘প্রশ্নাতীত সমর্থন’ দিয়েই যাবে? তবে ভারতীয় বিশ্লেষকদের বড় একটি অংশের অভিমত, দেশটির সরকারের উচিত ২০২৪ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ যাতে জেতে, সে জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করা।


আর শেখ হাসিনার সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি চাপ ভারতকে বাড়তি সুবিধা দিতে পারে, এমনটি উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, র‍্যাবের নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা নীতির বিষয়ে শেখ হাসিনার অবস্থানের প্রতি চীনের সমর্থনের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে মধ্যস্থতা করার সুযোগ নিতে পারে ভারত।


এ ছাড়া, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে বিরোধ তৈরি হতে পারে, এমন ইঙ্গিত দিয়ে আলী রীয়াজ লিখেছেন, যদি কোনো বিরোধ দেখা দেয়, সেই বিরোধে যে-ই জিতুক, তার ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশে আগামী দিনগুলোয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি কী হবে।


মুম্বাইভিত্তিক দ্য ইকোনমিক টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৩ জুন দিল্লিতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে তাঁর মার্কিন প্রতিপক্ষ জ্যাক সুলিভানের আলোচনায়ও স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। বৈঠকে সুলিভানকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিষয়ে মার্কিনদের এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যা ভারতের স্বার্থের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।


পাকিস্তানে এবারের পটপরিবর্তনে আমেরিকার ভূমিকা আছে বলে দেশটির সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যে অভিযোগ করেছেন, তার উল্লেখ করে গুয়াহাটিভিত্তিক নর্থ ইস্ট পলিসি ইনস্টিটিউটের পরিচালক রামি নিরঞ্জন দেশাই বলেছেন, বাংলাদেশে নির্বাচন সামনে রেখে যা ঘটে চলেছে, তার ওপর ভারতকে অবশ্যই তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। ইন্ডিয়া টুডে-তে ৫ জুন প্রকাশিত এক প্রবন্ধে তিনি এ কথা বলেন।


রামি দেশাই লিখেছেন, বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার নামে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘হস্তক্ষেপের’ যে উদাহরণ আছে, সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন পর্যন্ত সামনের দিনগুলোয় শেখ হাসিনাকে সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে।


শেয়ার করুন