মেয়র পদে সহজ জয় পেলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত দুই মেয়র প্রার্থী। নৌকা প্রতীক নিয়ে রাজশাহীতে এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ও সিলেটে মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। এ নিয়ে খায়রুজ্জামান লিটন রাজশাহীতে তৃতীয়বারের মতো নগরপিতা হলেন। আর সিলেটে প্রথমবার নির্বাচন করেই জয় পেলেন আনোয়ারুজ্জামান।
রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তারা স্ব স্ব নির্বাচনি এলাকায় বুধবার রাতে বেসরকারি ফলাফল ঘোষণা করেন। জয়ী হয়েই দুই মেয়র পৃথক প্রতিক্রিয়ায় তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেন। সিলেট নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করেছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী নজরুল ইসলাম (বাবুল)। ভোটের নামে নির্বাচন কমিশন পূর্বপরিকল্পিত নাটক সাজিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এর আগে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্র্যন্ত দুই সিটিতে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হয়।
দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর ওপর হামলার অভিযোগে রাজশাহী ও সিলেট সিটি নির্বাচন বর্জন করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীরা। শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় দুই সিটিতে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীরা সহজেই জয় পেতে যাচ্ছেন-এমন ধারণা আগে থেকেই ছিল স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে। বুধবার দুই সিটির ফলাফলে তারই প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। তবে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি। রাজশাহীতে ৫৬.২০ শতাংশ ও সিলেটে ৪৬.৭১ শতাংশ ভোট পড়েছে।
রাজশাহীর শিল্পকলা একাডেমিতে স্থাপিত ‘ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্রে’ বুধবার রাত ৯টা ৫ মিনিটে এ সিটি নির্বাচনের বেসরকারি ফল ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন। ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী, এক লাখ ৪৬ হাজার ৮০৭ ভোটের ব্যবধানে তৃতীয় মেয়াদে নগরপিতা নির্বাচিত হলেন জাতীয় চার নেতার অন্যতম এএইচএম কামারুজ্জামানের সন্তান এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। ভোট পাওয়ার দিক থেকে তার কাছেও ভিড়তে পারেননি বাকি তিন মেয়র প্রার্থী।
লিটন পেয়েছেন এক লাখ ৬০ হাজার ২৯০ ভোট। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. মুরশিদ আলম (হাতপাখা) পেয়েছেন ১৩ হাজার ৪৮৩ ভোট। যদিও তিনি আগেই ভোট বর্জন করেছেন। বাকি দুই মেয়র প্রার্থীর মধ্যে জাকের পার্টির মো. লতিফ আনোয়ার (গোলাপফুল) ১১ হাজার ৭১৩ ও জাতীয় পার্টির মো. সাইফুল ইসলাম স্বপন (লাঙ্গল) ১০ হাজার ২৭২ ভোট পেয়েছেন। এ নির্বাচনে খায়রুজ্জামান লিটন (নৌকা) ছাড়া বাকিরা এতই কম ভোট পেয়েছেন যে, তারা জামানতের টাকাও রক্ষা করতে পারেননি। রাজশাহী সিটিতে তিন লাখ ৫১ হাজার ৯৮২ জন ভোটারের মধ্যে ভোট পড়েছে এক লাখ ৯৭ হাজার ৮২৮টি। ভোট পড়ার হার ৫৬ দশমিক ২০ শতাংশ।
অপরদিকে প্রথমবার নির্বাচন করেই ৬৯১২৯ ভোটের ব্যবধানে সিলেটের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী (নৌকা)। তিনি পেয়েছেন এক লাখ ১৯ হাজার ৯৯১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির নজরুল ইসলাম বাবুল (লাঙ্গল) পেয়েছেন ৫০ হাজার ৮৬২ ভোট। বুধবার রাত সাড়ে ৯টায় সিলেটের জালালাবাদ গ্যাস অডিটোরিয়ামে এ সিটির ফল ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফয়সল কাদের।
ভোট বর্জন করেও এ সিটিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. মাহমুদুল হাসান (হাতপাখা) ১২ হাজার ৭৯৪ ভোট পেয়েছেন। সিলেটে ৪ লাখ ৮৭ হাজার ৮১১ ভোটের মধ্যে ভোট পড়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার ৬৪৩টি। ভোট পড়ার হার ৪৬.৭১ শতাংশ। সিলেটে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সাতজন প্রার্থী। একা একাই প্রচার চালিয়েও ২৯ হাজার ৬৮৮ ভোট পেয়ে চমক দেখিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. শাহ জাহান মিয়া (বাস গাড়ি)। অন্যান্য প্রার্থীর মধ্যে জাকের পার্টির (গোলাপ ফুল) মো. জহিরুল আলম ৩৪০৫ ভোট, স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আব্দুল হানিফ কুটু (ঘোড়া) ৪২৯৬ ভোট, মোশতাক আহমেদ রউফ মোস্তফা ২৯৫৯ ভোট ও মো. ছালাহ উদ্দিন রিমন (ক্রিকেট ব্যাট) ২৬৪৮ ভোট পেয়েছেন।
দুই সিটি করপোরেশনেই বুধবার রাতে ফলাফল ঘোষণার পর উৎসবে মেতে ওঠেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। নতুন দুই মেয়রকে ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানান দলীয় নেতাকর্মী ও বিভিন্ন পেশা ও সংগঠনের নেতারা। এর আগে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোটগ্রহণ চলে।
শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণ : রাজশাহী ও সিলেট নির্বাচন নিয়ে নানা শঙ্কা ও আলোচনা থাকলেও দু-একটি ঘটনা ছাড়া দুই সিটিতে শান্তিপূর্ণভাবেই ভোটগ্রহণ শেষ হয়। সার্বিক বিবেচনায় দুই সিটিতেই ভোটার উপস্থিতি ছিল মোটামুটি। ইভিএমে ভোটগ্রহণ জটিলতার কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হয় ভোটারদের। রাজশাহীতে অনেক কেন্দ্রে নৌকা ছাড়া মেয়র পদের অন্য কোনো প্রার্থীর এজেন্ট ছিল না। তবে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াতের যারা নির্বাচন করেছেন তাদের এজেন্টদেরও দেখা গেছে।
অপরদিকে সিলেটে বেশিরভাগ কেন্দ্রে নৌকা ছাড়াও লাঙ্গল প্রতীকের এজেন্ট ছিল। অন্য মেয়রদের তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি। রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন সকাল ৯টার দিকে নিজের ভোট দেন নগরের স্যাটেলাইট টাউন হাইস্কুল কেন্দ্রে। দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে ভোট দেন তিনি। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এই নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি ভুল করেছে। এ সময় ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদের কথাও জানান তিনি। ভোটদান শেষে কেন্দ্র পরিদর্শনে বের হন। কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে সকাল সোয়া ১০টার দিকে তিনি ১৬নং ওয়ার্ডের আটকষি স্কুলকেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছান।
এদিকে আটকষি স্কুলকেন্দ্রে নিজের ভোট দেন জাতীয় পার্টির মেয়রপ্রার্থী সাইফুল ইসলাম স্বপন। কেন্দ্রের বাইরে আসতেই দুই প্রার্থীর মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়। এ সময় লিটন ও স্বপন পরস্পরকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে আলিঙ্গন করেন। কয়েক মিনিট কথা বলার পর লিটন কেন্দ্রটি ত্যাগ করে অন্য কেন্দ্রের উদ্দেশে চলে যান।
পরস্পরের সৌহার্দভাব দেখে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে জাপা প্রার্থী স্বপন বলেন, লিটন ও আমি পরস্পরকে চাচা ও ভাতিজা বলে ডাকি। দেখা হলেই লিটন আমাকে সম্মান করেন। তবে ভোটের মাঠে আমরা কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছি না। আমরা পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রার্থীদের মধ্যে সৌহার্দভাব থাকা খারাপ কিছু নয়। এতে বরং রাজনীতির গুণগতমান বাড়ে। আমরা তেমন রাজনীতি করি না। জনগণ যাকে রায় দেবেন তিনি জিতবেন। জনগণের এই রায় আমাদের সহজ ও স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে হবে।
অপরদিকে সকাল ৮টা ২০ মিনিটে সিলেট মহানগরের ৮নং ওয়ার্ডের পাঠানটুলা শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসাকেন্দ্রে ভোট দেন নৌকা প্রতীকের আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। ভোট দেওয়ার পরই নিজের জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদ ব্যক্ত করেন। একইসঙ্গে পরাজিত হলেও ফল মেনে নেবেন বলেও জানান। আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, নির্বাচনে জয়-পরাজয় আছে, আমি জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। যদি কোনো কারণে বিজয়ী হতে না পারি, যিনি বিজয়ী হবেন আমি তার বাড়িতে ফুল নিয়ে যাব।
এদিন সকাল সাড়ে ৯টায় লাঙ্গল প্রতীকের মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল আনন্দ নিকেতন স্কুলকেন্দ্রে ভোট দেন। ভোট দেওয়ার পর তিনি অভিযোগ করেন, নির্বাচনে পেশিশক্তির ব্যবহার হচ্ছে। আমার এজেন্টদের অনেক কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এভাবে সুষ্ঠু ভোট হয় না। এছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের মো. আব্দুল হানিফ কুটু, ক্রিকেট ব্যাট প্রতীকের মো. ছালাহ উদ্দিন রিমন, বাস প্রতীকের মো. শাহজাহান মিয়া, হরিণ প্রতীকের মোশতাক আহমেদ রউফ মোস্তফা, জাকের পার্টির গোলাপ ফুল প্রতীকের জহিরুল ইসলাম তাদের নিজ নিজ কেন্দ্রে ভোট দেন।
অপরদিকে সিসিকের বর্তমান মেয়র আরিফুল হক নগরী ছেড়ে ভোটের দিনে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে দাদাবাড়িতে ছিলেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমরা নির্বাচন বর্জন করেছি তাই অবসরের এই দিনে দাদাবাড়িতে আম কুড়াতে গেছি।
এ দুই সিটি করপোরেশনে ভোটগ্রহণের মধ্য দিয়ে জাতীয় সংসদের আগে বড় ধরনের নির্বাচন শেষ করল ইসি। এর আগে কমিশন গাজীপুর, খুলনা ও বরিশাল সিটিতে ভোটগ্রহণ করেছে। বড় ধরনের কোনো সহিংসতা ছাড়াই প্রতিটি নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হয়েছে। গত ২৫ মে অনুষ্ঠিত গাজীপুরে ৪৮.৭৬ শতাংশ এবং গত ১২ জুন অনুষ্ঠিত খুলনায় ৪৮.১৭ শতাংশ ও বরিশালে ৫১.৪৬ শতাংশ ভোট পড়েছে। গাজীপুর ছাড়া বাকি চারটিতেই আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীরা বড় ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। একমাত্র গাজীপুর সিটিতে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন জয়ী হন।
দুই সিটিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় : নির্বাচনি ইশতেহার অনুযায়ী দুই সিটি করপোরেশনকে এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নবনির্বাচিত দুই মেয়র। জয়ের পরই বুধবার রাতে রাজশাহী নগরীর রানীবাজারস্থ রাজনৈতিক কার্যালয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, আমি নগরবাসীকে যে ওয়াদাগুলো করেছি, পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়ন করব। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহায়তা চাইব। তিনি ছাড়া আমার পক্ষে কোনো কিছু করা সম্ভব নয়। আমি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলো তৈরি করতে চাই। সেজন্য যতদূর যাওয়া দরকার, আমি যাব।
লিটন আরও বলেন, রাজশাহী মহানগরীর ভৌগোলিক আয়তন ৯৬ বর্গকিলোমিটার থেকে বাড়িয়ে ৩৫০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে। এ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করায় মহানগরবাসীর প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।
অপরদিকে ফল ঘোষণার পর সিলেট নগরীর মির্জা জাঙ্গালে প্রধান কার্যালয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানান আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, এ বিজয় সিলেটবাসীর, এ বিজয় ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগের। আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ তাদের হারাতে পারে না, তা আবার প্রমাণিত হলো। দায়িত্ব নেওয়ার পর নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি যেগুলো আছে সেগুলো নগরবাসীকে সঙ্গে নিয়ে পূরণ করব। তিনি আরও বলেন, আমার নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে সিলেট সিটি করপোরেশনের নগরপিতা নয়, সেবক হিসাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আমিও তা হতে চেয়েছি এবং আপনাদের কাছে এসেছি। সিলেটবাসী আমাকে যে ভালোবাসা জানিয়েছেন, আপন করে গ্রহণ করেছেন, সেই ঋণ জীবনে শোধ হওয়ার নয়। তবে আমি আমার উন্নয়ন তৎপরতা, সেবা আর ইশতেহার ঘোষিত ২১ দফা বাস্তবায়নের মাধ্যমে তার প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করব। সেজন্য অবশ্যই সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতাদের পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি চাই আমাদের এই আধ্যাত্মিক পুণ্যভূমিকে একটি স্মার্ট ক্লিন ও তিলোত্তমা নগরী হিসাবে গড়ে তুলতে।