২২ নভেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ০১:৪৭:১১ পূর্বাহ্ন
শুল্কে ছাড় ৫৬ হাজার কোটি, সুফল পায়নি মানুষ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৩-০৭-২০২৩
শুল্কে ছাড় ৫৬ হাজার কোটি, সুফল পায়নি মানুষ

টাকার অভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। সব ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধনের চেষ্টা চলছে। রাজস্ব ঘাটতির কারণে নতুন টাকা ছাপিয়ে আর ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তহবিল সংকটে সরকার যখন হিসেবি, তখনই রাজস্ব বা শুল্কছাড়ের বেহিসেবি তথ্য সামনে এল।


অর্থসংকট কাটাতে যখন বড় রাজস্ব আয় করার কথা, সেখানে উল্টো ১১ মাসেই অবাধ ছাড় দিয়ে ৫৬ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি করা হয়েছে। এ সুযোগ নিয়েছে ভোজ্যতেল আমদানিকারক, মোবাইল ফোনসেট উৎপাদক ও পোলট্রিশিল্প এবং বিভিন্ন সরকারি সংস্থা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক প্রতিবেদন থেকে বিপুল পরিমাণ শুল্কছাড়ের তথ্য জানা গেছে।


এনবিআর সূত্রে জানা যায়, বিদায়ী অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত ভোজ্যতেলের আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট ছাড় দেওয়া হয়। এতে রাজস্ব ক্ষতি হয় ৩ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে ছাড়ের পরিমাণ ছিল ৬১৮ কোটি টাকা। শুল্কছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তি ছিল, এতে ভোক্তারা কম দামে ভোজ্যতেল কিনতে পারবেন। অথচ ভোজ্যতেলের দাম দফায় দফায় বেড়েছে। একইভাবে দেশে মোবাইল ফোন উৎপাদন খাতে ২ হাজার ১৫৩ কোটি টাকার শুল্কছাড় দেওয়া হয়।


তখন বলা হয়েছিল, এর ফলে অপেক্ষাকৃত কম দামে মানুষ মোবাইল ফোনসেট কিনতে পারবে। অথচ বাজারে মোবাইল ফোনসেটের দাম খুব একটা কমেনি। পোলট্রিশিল্পে ছাড় দেওয়া হয় ৮৯৩ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে ছিল ৬৭২ কোটি টাকা। বাস্তবে পোলট্রি পণ্য, বিশেষ করে ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দাম বেড়েছে।


এর বাইরে টেক্সটাইল খাত ছাড় পেয়েছে ৮৬৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) ১ হাজার ১২ কোটি টাকা এবং পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি ৭২৫ কোটি টাকা শুল্কছাড় নিয়েছে। এনবিআরের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ৫ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা, অগ্রিম আয়করসহ অন্যান্য খাতে ৮১৬ কোটি টাকার শুল্কছাড় দেওয়া হয়েছে। বিশেষ অব্যাহতির মাধ্যমে ছাড় দেওয়া হয়েছে ৮ হাজার ১৯৮ টাকার শুল্ক। মূলধনি যন্ত্রপাতি কিনতে ছাড় দেওয়া হয়েছে ৮ হাজার ৯০১ কোটি টাকা, ত্রাণসামগ্রী খাতে ছাড় দেওয়া হয়েছে ২৮৩ কোটি টাকা, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামালের ছাড় ৩ হাজার ৪১১ কোটি টাকা, শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ছাড় দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা।


বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সিংহভাগ সুবিধাই গেছে ব্যবসায়ীদের পকেটে। তাঁরা বলছেন, ঠিকমতো রাজস্ব আয় না হওয়ার পরিস্থিতিতেও বিভিন্ন খাতে শুল্কছাড় দেওয়ার কারণেই সরকারকে বিপুল অঙ্কের টাকা ধার করতে হয়েছে। এমনকি নতুন অর্থবছরের শুরুতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ধার করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, মাত্র ২০ দিনেই সরকার ১৩ হাজার কোটি টাকা ধার করেছে। বিদায়ী অর্থবছরে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৮৩০ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে তা ছিল ২ লাখ ৭৭ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা।


শুল্কছাড় প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আইএমএফের (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) শর্ত হলো উল্লেখযোগ্যভাবে কর অব্যাহতি কমানো। আমরা তো উল্টো দিকে যাচ্ছি। সরকার যদি উল্টো দিকে যায় তাহলে তো মুশকিল। টাকার অঙ্কে ঘাটতি বাড়ায় সরকারের ঋণ বাড়ছে। দেশি-বিদেশি ঋণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এই ঋণ পরিশোধ করার সক্ষমতা আমাদের ব্যাংকিং খাতের নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ ঋণই নিক না কেন, সেটা উদ্বেগের কারণ। আর এ সবই হচ্ছে মূলত রাজস্ব ঘাটতির কারণে। এতে ব্যয়সংকোচন করা হচ্ছে, ঋণ বাড়ছে, সুদ বাড়ছে এবং আমরা প্রয়োজনীয় ব্যয় করতে পারছি না।’


এনবিআরের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা অনুযায়ী, স্বল্প করহার, কর অব্যাহতি ও কর অবকাশ সুবিধার কারণে কর-জিডিপি অনুপাত ২ দশমিক ২৮ শতাংশ কম হচ্ছে। এসব সুবিধা তুলে দিলে কর-জিডিপি অনুপাত ১০ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশে দাঁড়াবে। অথচ সেদিকে নজর সীমিত বলে মনে করছেন রাজস্ব খাতের বিশেষজ্ঞরা।


ব্যবসায়ীরা অবশ্য শুল্কছাড়ের পক্ষে। এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ভোজ্যতেলে ভ্যাট সুবিধা না দিলে ১৮০ টাকার পরিবর্তে ভোক্তারা ২১০ টাকায় খেত। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে সরকার ছাড় দিয়েছে এবং এতে অবশ্যই ভোক্তারা উপকৃত হয়েছে। তা না হলে ভোক্তাদের আরও কষ্ট হতো।’ এই সুবিধা প্রকৃতপক্ষে কারা বেশি পেল, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই ভোক্তারা বেশি পেয়েছে। ব্যবসায়ীর কি লাভ? ব্যবসায়ীরা তো ভোক্তাদের কাছ থেকেই ভ্যাট আদায় করে সরকারকে দিতেন। ব্যবসায়ীর কী আছে এখানে?’


কোভিডজনিত অর্থনৈতিক সংকট আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে চাপে পড়ে বিশ্ব অর্থনীতি। এর ধাক্কা লাগে বাংলাদেশেও। সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে ডলার সাশ্রয়সহ কৃচ্ছ্রসাধনের নানামুখী পদক্ষেপ নেয়। পাশাপাশি বড় রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ঠিক করে। এর সঙ্গে যোগ হয় আইএমএফের কঠিন সব শর্ত। এর অন্যতম ছিল করছাড় কমিয়ে আনা এবং ধাপে ধাপে তা একেবারে তুলে দেওয়া। রাজস্ব আয় বাড়িয়ে কর-জিডিপি অনুপাতও দুই অঙ্কের ঘরে নিয়ে যাওয়ার চাপ ছিল।


এমন পরিস্থিতিতে রাজস্ব আয়ে হতাশাজনক অবস্থায় পড়ে এনবিআর। দুর্বল আদায় ব্যবস্থাপনার কারণে বিদায়ী অর্থবছরে প্রায় ৪৪ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা ঘাটতি থাকে। রাজস্ব আদায়ে সংস্থাটি যখন ক্রমেই পিছিয়ে, তখনো বিভিন্ন খাত ও সংস্থাকে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ছাড় অব্যাহত রাখা হয়। এনবিআরের শুল্কছাড়-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিদায়ী অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) এনবিআর ৫৬ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকার শুল্কছাড় দিয়েছে। এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে তা ছিল ৪৬ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা। যখন বেশি রাজস্ব আয় দরকার, তখন বাড়তি ৯ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা (২০ দশমিক ৩৫ শতাংশ) ছাড় দেওয়া হয়েছে।


এনবিআরের সাবেক সদস্য আবদুল মান্নান পাটোয়ারী অবশ্য বলেন, ‘আইএমএফ সব সময় চায় কোনো ধরনের রাজস্ব অব্যাহতি না দিতে। তবে সরকারকে জনগণের কথা ভাবতে হয়। ইচ্ছা না থাকলেও সরকারকে অনেক সময় রাজস্ব ছাড় দিতে হয়। যে পরিমাণ ছাড় দেওয়া হয়েছে, ততটুকু সুবিধা ভোক্তারা পাবে—এটা আশা করা যায় না। ব্যবসায়ীরা তাঁদের লাভের কথা চিন্তা করবেনই। ছাড় না দিলে এর অজুহাত দেখিয়ে হয়তো আরও দাম বাড়িয়ে দিতেন।’


বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দেখতে হবে কোন খাতে সুবিধা তুলে নিলে অর্থনীতিতে মোটাদাগে কোনো আঘাত আসবে না। অন্যদিকে রাজস্ব ক্ষতিও এড়িয়ে যেতে পারব। এমন অনেক সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যেখান থেকে কাঙ্ক্ষিত কোনো বেনিফিট পাওয়া যায় না, বরং অপব্যবহার হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সুবিধা তুলে নিলে রাজস্ব ক্ষতিটা কমবে এবং কর-জিডিপি অনুপাত বাড়বে।’ 


শেয়ার করুন