বৃহত্তর চট্টগ্রাম তথা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসছে আরেক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। চলতি বছরই চালু হচ্ছে কর্ণফুলী নদীর বুকে দেশের প্রথম টানেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন, চট্টগ্রাম নগরীর প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। শেষ হচ্ছে কক্সবাজার বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ কাজ। এ চার মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে যোগাযোগ খাতে সূচনা হচ্ছে আরেক দিগন্তের। তাই এ খাতের চার প্রকল্পকে অর্থনীতির জন্য ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু টানেল, এক্সপ্রেসওয়ে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন এবং কক্সবাজার বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ কাজ হবে যোগাযোগ খাতের জন্য যুগান্তকারী মাইলফলক। এ চার মেগা প্রকল্প দেশের অর্থনীতির জন্য হবে গেম চেঞ্জার। এ প্রকল্পগুলো দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে।’
ডায়মন্ড সিমেন্টের পরিচালক হাকিম আলী বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে যোগাযোগব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধু টানেল, এক্সপ্রেসওয়ে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন ও বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ কাজ অবশ্যই যোগাযোগ খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। এ পরিবর্তনের প্রভাব অর্থনীতিতে খুব ভালোভাবেই পড়বে।’ জানা যায়, চীনের সাংহাইয়ের ওয়ান সিটি টু টাউনের আদলে চট্টগ্রাম শহর ও আনোয়ারাকে এক সূত্রে যুক্ত করতে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে তৈরি হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ টানেল। ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকার মেগা প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। চলতি বছর জুলাই পর্যন্ত সার্বিক কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৯৯ শতাংশ। আশা করা হচ্ছে আগামী মাসে টানেলটি যান চলাচলের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের যোগাযোগ খাতে পদ্মা সেতুর পর টানেলকে দ্বিতীয় বিপ্লব মনে করা হচ্ছে। টানেলের মাধ্যমে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর ও মহেশখালীর আগামীর বাণিজ্যিক হাবের সঙ্গে যুক্ত হবে পুরো দেশ। টানেলের কারণে বিশেষ সুবিধা পাবে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দর, এলএনজি টার্মিনাল, এলপিজি টার্মিনাল, অয়েল টার্মিনাল, গ্যাস ট্রান্সমিশন, অয়েল রিফাইনারি, অ্যানার্জি ও ফুড স্টোরেজ, ট্যুরিজম, এমব্যাঙ্কমেন্ট ও ওয়াটারফ্রন্ট ইকোনমিক জোন। টানেল পুরোদমে চালু হলে প্রতিদিন গড়ে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি চলাচল করবে। বছরে সে সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ৬৩ লাখে। ২০২৫ সালে টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। এর মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ ১ লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সঙ্গে রেলপথে পুরো দেশকে যুক্ত করতে সেপ্টেম্বরে চালু হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেললাইনের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৮৫ শতাংশ। ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয় নির্মাণাধীন প্রকল্পটি পুরোদমে চালু হলে দেশের পর্যটন শিল্প আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে। পর্যটক ও স্থানীয় জনগণের জন্য নিরাপদ, আরামদায়ক, সাশ্রয়ী যোগাযোগব্যবস্থা তৈরি হবে। এ ছাড়া সহজ ও কম খরচে মাছ, লবণ, কাগজের কাঁচামাল, বনজ ও কৃষিজ পণ্য পরিবহন করা যাবে। প্রকল্পটি পুরোদমে চালু হলে হলে মিয়ানমার, চীনসহ ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের করিডরে যুক্ত হবে বাংলাদেশ। চট্টগ্রামে নগরীর যানজট নিরসনে বহু কাক্সিক্ষত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হচ্ছে নভেম্বরে। ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকার এ প্রকল্পের এরই মধ্যে সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে প্রায় ৮১ শতাংশ। এ মেগা প্রকল্প চালু হলে চট্টগ্রাম নগরীর প্রাণকেন্দ্র খ্যাত জিইসি মোড় থেকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত, কর্ণফুলী টানেল এলাকায় পৌঁছানো যাবে ২৫ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে। ফলে যাত্রীদের সময় সাশ্রয় হবে অন্তত দুই ঘণ্টা। এ এক্সপ্রেসওয়ের কারণে পর্যটন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও স্থানীয় যোগাযোগে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে। এ ছাড়া কর্ণফুলী টানেলের সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজারগামী যানবাহন চলাচলেও গতি আসবে। সাগরের বুক ছুঁয়ে যাওয়া কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ শেষ হচ্ছে চলতি বছরের শেষ দিকে। ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকার প্রকল্পের রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজে এরই মধ্যে অগ্রগতি হয়েছে ৮০ শতাংশ। ৩ দশমিক ২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে দৃষ্টিনন্দন রানওয়েটি হবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সমুদ্র শাসন করে তৈরি হওয়া প্রথম রানওয়ে। এটি চালু হলে রাত-দিন সমানভাবে বিমানবন্দরে উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে পারবে বিমান। চালু হবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। এতে করে বিদেশি পর্যটকরা সরাসরি এ বিমানবন্দরে অবতরণ করতে পারবেন। কক্সবাজারে বাড়বে বিদেশি পর্যটক। আরও সম্প্রসারণ হবে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের ট্যুরিজম বাণিজ্য। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘যোগাযোগব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের জন্য সরকার চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে টানেল, এক্সপ্রেসওয়ে, রেললাইন ও বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ, যা চলতি বছরই চালু হবে। চালু হলে এ প্রকল্পগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।’