২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৮:৪৭:৪৪ অপরাহ্ন
সমঝোতা চায় যুক্তরাষ্ট্র, কঠোর অবস্থানে সরকার
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-০৮-২০২৩
সমঝোতা চায় যুক্তরাষ্ট্র, কঠোর অবস্থানে সরকার

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ হয়, সে জন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এবং সরকারের সঙ্গে কথা বলছেন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিনিধিরা। তাঁদের চাওয়া পূরণ না হলে ভিসা নীতি ঘোষণার পর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের আশঙ্কার কথাও বলছে কূটনৈতিক সূত্রগুলো। তবে তেমন পরিস্থিতি এড়াতে রাষ্ট্রদূতসহ কূটনীতিকেরা সব পক্ষের সঙ্গে দফায় দফায় বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক চালিয়ে যাচ্ছেন।


গতকাল রোববার ঢাকায় সরকার, আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সফররত দুই মার্কিন কংগ্রেসম্যান এবং ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত। এসব বৈঠকে তাঁরা জানতে-বুঝতে চেয়েছেন ভোটের আগে দুই পক্ষের মধ্যৈ সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না। তবে সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিরোধীদের প্রধান যে দাবি, তা নিয়ে সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই।


রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, নির্বাচনের সময় সরকারপ্রধান হিসেবে কে থাকবেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বিএনপির মূল বিরোধ তা নিয়ে। আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখেই ভোটে যেতে চায়। আর ঠিক উল্টোটি চায় বিএনপি—শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। এখন পর্যন্ত দুই দলই অনড় নিজ নিজ অবস্থানে।


দুই কংগ্রেসম্যান—ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাট দলের এড কেস ও রিপাবলিকান রিচার্ড ম্যাককরমিক—সফরের প্রথম দিন গতকাল পরপর চারটি বৈঠকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন, তাঁরা স্থানীয় বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতার পথ খুঁজছেন। বিষয়টি তাঁরা পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে আলোচনায় তুলেছেন।


প্রায় দুই ঘণ্টা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন দুই কংগ্রেসম্যান। এরপর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতার পথ আছে কি না জানতে চেয়েছেন কংগ্রেসম্যানরা। তিনি তাঁদের বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে টেড কেনেডির মতো একজন আছেন, যিনি ঐকমত্যের জন্য মধ্যস্থতা করেছেন। এখানে ঐকমত্যের কোনো দাবি নেই। এখানকার বিরোধী দলের কাছে নির্বাচন নয়, সরকারের পতন গুরুত্বপূর্ণ, যা আলোচনার বিষয় নয়। বিরোধী দল বলছে, সরকারের পতন হবে, তারপর তারা নির্বাচন করবে। এই অবস্থায় সরকারের সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই।


দুই মার্কিন রাজনীতিক আগামী নির্বাচন নিয়ে প্রায় অচলাবস্থার মতো পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে কোনো ফর্মুলা দিয়েছেন কি না, এমন প্রশ্নে মোমেন ‘না’ বলেন। তিনি মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের বলেন, সরকার সংবিধানের ভিত্তিতে নির্বাচন করবে। সরকার মনে করে, এতে সবার অংশগ্রহণ করা উচিত।


কংগ্রেসম্যানরা নির্বাচন সামনে রেখে সহিংসতা এড়ানোর প্রসঙ্গটিও আলোচনায় আনেন। এ প্রসঙ্গে মোমেন বলেন, তিনি তাঁদের জানিয়েছেন, শুধু নির্বাচন কমিশন ও সরকার চাইলেই এটা নিশ্চিত করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে।


যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামোর অনেকের মতো এই দুই কংগ্রেসম্যানও মনে করেন, বাংলাদেশ চীনের খপ্পরে পড়ে গেছে। কোনো রাখঢাক না রেখে তাঁরা বিষয়টি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তুলেছেন। মন্ত্রী বলেন, তাঁকে কংগ্রেস সদস্যরা চীন থেকে বিপুল ঋণ নেওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘তোমরা চীনের ভেতরে চলে যাচ্ছ।’


মোমেন জানান, দুই কংগ্রেসম্যান বিভিন্ন মানুষের কাছে শুনেছেন, বাংলাদেশ ‘চীনের খপ্পরে’ পড়ে গেছে। আর এটি একটি ভয়ংকর জায়গা, যেখানে অশান্তি চলছে। পুলিশ যখন-তখন লোক ধরে ফেলছে এবং মেরে ফেলছে।


এ বিষয়ে মোমেন কংগ্রেসম্যানদের জানান, বাংলাদেশের মোট ঋণের মাত্র ১ শতাংশের মতো চীন থেকে নেওয়া, যা কোনো বড় বিষয় নয় বলে সরকার মনে করে।


তিন দলের সঙ্গে বৈঠক

চার দিনের সফরে দুই কংগ্রেসম্যান শনিবার রাতে ঢাকায় পৌঁছান। তাঁরা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের গুলশানের বাসভবনে আলাদা বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিদের সঙ্গে।


বৈঠকে কংগ্রেসম্যানরা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের কাছে ব্যাখ্যা করেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কেন বাংলাদেশের অবস্থা ও অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর সারা পৃথিবীতে যেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কমে যাচ্ছে, সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশে যেন গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকে, সেটা চায় আমেরিকা।


আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলে ছিলেন সংসদ সদস্য ওয়াসিকা আয়শা খান, নাহিম রাজ্জাক এবং তামান্না নুসরাত (বুবলী)। কংগ্রেসম্যান এড কেইস আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদলকে বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীর কাছে অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হবে।


আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, নির্বাচন কমিশনকে আইনের মাধ্যমে শক্তিশালী করা হয়েছে। আর সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো বিধান রাখা সম্ভব নয়। জাতীয় সংসদের সামনের অধিবেশনে আরেকটা আইন আসবে। তাতে নির্বাচনকালীন সময়ে বিশৃঙ্খলা করা হলে শাস্তির বিধান রাখা হবে। নির্বাচন পর্যবেক্ষক পাঠাতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করা হয়।


বিএনপির প্রতিনিধিদলে ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি। তিনি জানান, মার্কিন প্রতিনিধিদের তাঁরা বলেছেন, দেশে এক ব্যক্তির শাসন চলছে। এই অবস্থায় বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। একই সঙ্গে দলটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলেও উল্লেখ করে।


জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিদলে ছিলেন তিন সংসদ সদস্য শেরিফা কাদের, রানা মোহাম্মদ সোহেল ও নাজমা আকতার। রানা মোহাম্মদ সোহেল আজকের পত্রিকাকে বলেন, কংগ্রেস সদস্যরা বলেছেন, বাংলাদেশে এমন নির্বাচন হওয়া উচিত, যেন বহির্বিশ্ব বলতে পারে, নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে। 


পরিবেশ বুঝতে নাগরিক সমাজের সঙ্গে বৈঠক

মার্কিন দুই কংগ্রেসম্যান এড কেস ও রিচার্ড ম্যাককরমিক গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকায় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন। গুলশানে রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বাসভবনে এ বৈঠকে তাঁরা প্রধানত সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার সম্ভাবনা নিয়ে আলাপ করেন।


বৈঠকে অনেকের মধ্যে ছিলেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, দুই কংগ্রেসম্যান মূলত বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচনের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। বুঝতে চেয়েছেন, নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার কোনো সুযোগ আছে কি না। তবে দুই মার্কিন রাজনীতিক নিজেরা কোনো মন্তব্য করেননি।


মানবাধিকার সংগঠন আর্টিকেল ১৯-এর আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সালও ছিলেন বৈঠকে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে হলে কী করা দরকার, সে বিষয়গুলো আলোচনায় এসেছে। নির্বাচন প্রসঙ্গ তার মধ্যে একটি। তাঁরা জানতে চেয়েছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আগে ছিল কি না?


বৈঠকে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন কংগ্রেসম্যানদের জানান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আগে ছিল। এখন তা সংবিধানে নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, কংগ্রেসম্যানদের এমন প্রশ্নে কয়েকজন জানান, সেটা রাজনৈতিক দলগুলো ভালো বলতে পারবে।


প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, বিআইপিএসএস প্রেসিডেন্ট অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনিরুজ্জামান, নারীনেত্রী শিরিন হক, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান, অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খানসহ অন্যরা এ বৈঠকে অংশ নেন।


ছাড় সরকারকেই দিতে হবে

গত শনিবার বিএনপির উদ্দেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের দেওয়া বক্তব্যের উল্লেখ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একটি অংশ বলছে, দুই রাজনৈতিক পক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে তাদের মধ্যে সংলাপের সম্ভাবনাও তেমন দেখা যাচ্ছে না।


কাদের বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। মন চাইলে নির্বাচনে আসবেন, না হয় যা মন চায় তা করেন।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দুঃখজনক ব্যাপার হলো, তেমন কোনো বিষয়ই নেই, যা নিয়ে দুই পক্ষ আলোচনার টেবিলে বসতে পারে। এই অবস্থায় সংলাপের কোনো সুযোগ দেখি না।’


চলমান সংকট নিরসনে এখনো আলোচনাকেই গুরুত্ব দেওয়া দরকার বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। আর এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগী হওয়া দরকার বলে মনে করেন তাঁরা।


জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, আলোচনার উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকেই আগে আসা দরকার। তাদেরই ছাড় দিতে হবে। তা না হলে দুই দলকে আলোচনায় বসানো সম্ভব নয়। আর এই আলোচনা না হলে বিরোধী দল রাজপথে সমাধান খুঁজবে।


শেয়ার করুন