বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব। গত সাত মাসে বিদেশে যাওয়া কর্মীদের ৩৬ শতাংশই গেছেন সৌদি আরবে। কিন্তু দেশটি হঠাৎ আরও ২৮ শ্রেণির কর্মী নেওয়ার ক্ষেত্রে দক্ষতার সনদ বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলো পুরো সক্ষমতায় না আসায় সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানি কমার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা।
সূত্র বলেছে, গত ২৫ জুলাই ঢাকার সৌদি দূতাবাস নতুন ২৮টিসহ মোট ৩৩ ধরনের পেশায় কর্মীদের দক্ষতার সনদ বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। চিঠি পাওয়ার সময় থেকেই এটি কার্যকর বলেও উল্লেখ করা হয়। চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয় প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালককে। চিঠিটি আসার পর থেকে বিএমইটিতে সৌদি আরবগামী কর্মীদের ছাড়পত্র দেওয়া নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। নির্দেশনা বাস্তবায়নে আরও সময় প্রয়োজন জানিয়ে সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সৌদি দূতাবাসে চিঠি দিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
বিভিন্ন সূত্রমতে, বর্তমানে সৌদি আরবে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশি কর্মী রয়েছে। বিএমইটির তথ্য বলছে, চলতি বছরের সাত মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) মোট ৭ লাখ ৪৩ হাজার ৪২৬ জন কর্মী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন। তাঁদের মধ্যে সৌদি আরবে গেছেন ২ লাখ ৬৫ হাজার ৭৩৩ জন, যা সাত মাসে জনশক্তি রপ্তানির ৩৬ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্মী গেছেন মালয়েশিয়ায়, ২ লাখ ১৮ হাজার ৪১৫ জন। প্রবাসী আয় আসার ক্ষেত্রেও শীর্ষে সৌদি আরব। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সৌদি আরবপ্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠান ৩৭৬ কোটি ৫২ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার। আগের অর্থবছরে এসেছিল ৪৫৪ কোটি ১৯ লাখ ৬০ হাজার ডলার।
সূত্র বলেছে, এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পাইলট প্রকল্প হিসেবে সৌদি আরব পাঁচটি পেশার কর্মীদের দক্ষতার সনদ বাধ্যতামূলক করে। এগুলো হলো প্লাম্বার, ওয়েল্ডিং, অটোমোবাইল, ইলেকট্রিশিয়ান ও এসি মেকানিক। ২৫ জুলাই চিঠিতে আরও যে ২৮টি কাজে দক্ষতার সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সেগুলো হলো মাইন রুফিং ইনস্টলার, ডেমোলিশন ওয়ার্কার, ড্রিলিং ওয়ার্কার, ব্রিকস মেকার, মেশন, ক্লে অ্যান্ড সিনথেটিক মেকার, বিল্ড স্টাকস, স্টোন মেকার, কমপোনেন্টস, রেডি মিকস কংক্রিট, কনস্ট্রাকশন, মোজাইক মল্ডিং এজেন্ট, শিট মেটাল রুফিং এবং ওয়ার্কার; স্টিম কনস্ট্রাকশন, টিম্বার অ্যান্ড মুড রুফিং, উডেন ফ্লোর ইনস্টেলার, রুফিং ওয়ার্কার ও পেভড এবং ইনিশিয়াল কার মেইনটেন্যান্সের মোজাইক কম্পাউন্ড, ইউজ টায়ার রিবিল্ডার, ভেহিক্যাল গ্লাস রিপেয়ার ও টায়ার কম্পাউন্ড বিল্ডার; প্লাস্টার মেলিসা, কার মেকানিক, মোটরসাইকেল মেকানিক ও বাস মেকানিক।
২৫ জুলাইয়ের চিঠিতে সৌদি দূতাবাস বলেছে, শ্রম ভিসায় সৌদি আরব যেতে হলে বাধ্যতামূলকভাবে পরীক্ষা দিয়ে দক্ষতার সনদ নিতে হবে। চিঠিতে যত দ্রুত সম্ভব সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানায় দূতাবাস। তবে সনদের জন্য কর্মীর দক্ষতার পরীক্ষা কে নেবে তা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়নি। ওই চিঠি পাওয়ার পর বিএমইটি থেকে জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সৌদি আরবগামী ওই ৩৩টি পেশার কর্মীদের বহির্গমন ছাড়পত্রের আবেদনের সঙ্গে দক্ষতার সদন দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সম্প্রতি এক সভায় বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম বলেন, সৌদি দূতাবাসের উল্লেখ করা খাতগুলোতে দক্ষ জনশক্তি পাঠাতে একটি পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় পরীক্ষা দিয়ে দক্ষতার সনদ নিয়ে সৌদি আরব যেতে হবে।
বিএমইটি সূত্র বলেছে, গত ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরব পাঁচটি খাতে দক্ষতার সনদ বাধ্যতামূলক করার পর পাইলট প্রকল্প নিয়ে এসব খাতে সনদ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া নির্মাণকাজসংশ্লিষ্ট ১৫ খাত, গাড়ি মেরামতসংশ্লিষ্ট চার খাত, টাইলিংসংশ্লিষ্ট পাঁচ খাত ও প্লাস্টার কাজের পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে। পরীক্ষা নেওয়ার জন্য ছয়টি কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হলো বাংলাদেশ-কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিকেটিটিসি) ঢাকা ও চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী, বরিশাল, কুমিল্লা ও টাঙ্গাইলের কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি)। এই পরীক্ষা নিতে বিএমইটি ও সৌদি সরকারি সংস্থা তাকানলের মধ্যে চুক্তি হয়েছে।
জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলো আগের পাঁচটি খাতের কর্মীদের দক্ষতার পরীক্ষা নিয়ে সনদ দিতে সক্ষম ছিল। কিন্তু সৌদি দূতাবাস নতুন আরও ২৮টি পেশায় দক্ষতার সনদ বাধ্যতামূলক করায় ওই শ্রমবাজার ঘিরে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, হঠাৎ করে দক্ষতার সনদ সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। যেকোনো নির্দেশনা বাস্তবায়নে সময় প্রয়োজন। বিষয়টি তাঁরা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন। আশা করছেন, মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে। নয়তো সৌদি আরবে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।