অর্থনৈতিক সংকটে একদিকে সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলছে, অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে চলছে গণহারে প্রকল্প অনুমোদন। সরকারের শেষ সময়ে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পও অনুমোদনের তালিকায় উঠছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) গত দুটি সভায় অনুমোদন পায় ৩৪টি প্রকল্প। আগামী মঙ্গলবারের সভায়ও অনুমোদনের জন্য উঠছে ২০ হাজার কোটি টাকার ৩২টি প্রকল্প। আরও অন্তত অর্ধশত প্রকল্প অপেক্ষমাণ।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, নির্বাচনের আগে এসব প্রকল্পের বেশির ভাগই রাজনৈতিক বিবেচনার। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সবই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রায় দেড় মাস একনেক বৈঠক হয়নি, তাই প্রকল্পের সংখ্যা একটু বেশি হয়েছে। একনেকে যাচাই-বাছাই করে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পই অনুমোদন দেওয়া হয়।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, পরবর্তী একনেক সভার তারিখ ঠিক হয়েছে ২৯ আগস্ট মঙ্গলবার। সেই সভায় অনুমোদনের জন্য একসঙ্গে অনেক প্রকল্প তোলা হচ্ছে। বেশির ভাগ প্রকল্পেরই অর্থায়ন হবে সরকারের তহবিল থেকে।
সংকটের সময় অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের ওপর জোর দেওয়ার কথা বলেছে সরকার। তবে প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। শিশুপার্কের উন্নয়ন, কালেকটরেট ভবন নির্মাণ, কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র নির্মাণ, কারাগার সংস্কার, সার্কিট হাউস নির্মাণ, সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণের মতো প্রকল্পও থাকছে তালিকায়।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, এবার অনুমোদনের জন্য উঠছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রস্তাবিত ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শিশুপার্ক আধুনিকীকরণ প্রকল্প’। শুরু থেকে প্রকল্পটির কোনো কোনো খাতে মাত্রাতিরিক্ত দর নিয়ে সমালোচনা হয়।
এমনকি এ নিয়ে আলাদা কমিটিও হয়। তারপরও ৬০০ কোটি টাকার প্রকল্পটি একনেকে তোলা হচ্ছে। এ ছাড়া এবার একনেকে উঠছে বাগেরহাট কালেকটরেটের নতুন ভবন নির্মাণ প্রকল্প, পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়ক থেকে মাদানি অ্যাভিনিউ পর্যন্ত সংযোগকারী দুটি সড়ক উন্নয়ন, সিলেট সড়ক বিভাগের অধীন সিলেট (তেলিখাল)-সুলতানপুর-বালাগঞ্জ (জেড-২০১৩) সড়কের ২৫তম কিলোমিটারে বড়ভাঙ্গা সেতু নির্মাণ, মুন্সিগঞ্জ সড়ক বিভাগের আওতায় রামেরকান্দা-লাকিরচর (রোহিতপুর বাজার) সংযোগ সড়ক (আর-৮২৩) উন্নয়ন ইত্যাদি প্রকল্প।
অর্থসংকটের সময়ে এসব প্রকল্প নেওয়া প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘কোন সংসারে একটু টানাটানি থাকে না? শিশুপার্কও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প, মায়েরা বাচ্চাদের নিয়ে আসবে খেলাধুলার জন্য। কালেকটরেট ভবন নির্মাণও গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে মানুষ সেবার জন্য আসে।’
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, অনুমোদিত ও অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা প্রকল্পগুলোর মধ্যে গ্রামীণ এলাকার সড়ক ও অবকাঠামোর প্রকল্পই বেশি। ভোটের সময় প্রচারে কাজে এসব লাগানো যায়। গত জুনের একনেক সভায় ১৬টি প্রকল্প অনুমোদিত হয়। এর মধ্যে ১০টি গ্রামীণ ও আঞ্চলিক অবকাঠামো এবং সড়কের প্রকল্প। ওই ১০ প্রকল্পের মধ্যে নতুন প্রকল্পের ব্যয় ও পুরোনো প্রকল্পের বাড়তি ব্যয় মিলে মোট
খরচ প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া জুলাই মাসেও ১৭টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়, যার বেশির ভাগ গ্রামীণ অবকাঠামোর। এতে ব্যয় হবে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে প্রকল্পগুলো অনুমোদন-পূর্ব প্রক্রিয়া শেষ করতে গত শুক্র ও শনিবার ছুটির দিনেও কয়েকজন কর্মকর্তা অফিসে গিয়ে কাজ করেছেন। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের আনাগোনাও ছিল পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে।
পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আর এক মাসের মতো বাকি। তখন আর একনেক বৈঠক হওয়ার সুযোগ নেই। শুধু রুটিন কাজ হবে। তাই তার আগে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ভোটারদের কাছে টানতে সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ আসনের অবকাঠামো উন্নয়নে প্রকল্প নেন। সব সরকারই শেষ সময়ে এসে প্রকল্প অনুমোদন বাড়িয়ে দেয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া এসব প্রকল্পে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দও পায় না, ঠিকমতো কাজও হয় না, মানুষও সুফল পায় না।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সরকারের কাছে তো টাকাই নেই। তার ওপর খরচ বাড়াচ্ছে। সামনে নির্বাচন, সরকারের স্ট্র্যাটেজি কী বলা মুশকিল। প্রকল্পও বাস্তবায়ন করতে হবে, সমস্যা হচ্ছে বেশির ভাগই সরকারি অর্থায়নের প্রকল্প। সব নির্চানের আগে সরকার এমন করে থাকে। যদিও এটা উচিত না। এগুলো রাজনৈতিক প্রকল্প। এসব প্রকল্পে হয়তো কিছু থোক বরাদ্দ দেওয়া হবে।’