চা শ্রমিকদের দৈনিক নিম্নতর মজুরি ১৬৮-১৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের স্কেল সর্বনিম্ন ৮ হাজার ৬৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ৯৩৬ টাকা। বছরে বেতন ৫ শতাংশ হারে বাড়বে।
দীর্ঘ আন্দোলন, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ এরপর এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পর সম্প্রতি মজুরি স্কেলের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
শ্রমিকদের দাবি ছিল দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার। কিন্তু বাগান মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রধানমন্ত্রী ন্যূনতম মজুরি ঠিক করে দেন। সে অনুযায়ী মজুরি ও স্কেল চূড়ান্ত করা হয়।
নতুন বেতন স্কেলে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা শ্রমের পর অতিরিক্ত কাজের জন্য অধিককাল ভাতা (ওভারটাইম) পাবেন। বছরে বেতন ৫ শতাংশ হারে বাড়বে।
জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এহছানে এলাহী শনিবার যুগান্তরকে জানান, চা শিল্পের শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করেই তাদের মজুরি ও বেতন স্কেল ঠিক করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া তাদের বেতন প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধির বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। আগের অন্য সুবিধাগুলোও বহাল। প্রধানমন্ত্রী যে সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন তার ওপরই এটি কার্যকর করা হয়েছে।
জানা গেছে, আগে বিভিন্ন সময়ে দৈনিক মজুরি বেড়ে আট টাকা, ১২ টাকা, ১৮ টাকা, ২০ টাকা, ২২ টাকা, ২৪ টাকা হয়। ২০০৮ সালে ৩২ টাকা হয়। ২০০৯ সালে ৪৮ টাকা, ২০১৭ সালে ১০২ টাকা এবং সর্বশেষ ২০২০ সালে তা ১২০ টাকায় দাঁড়ায়।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশি চা সংসদের আইন অনুযায়ী-শ্রমিকদের বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, রেশন, পানীয় জলের ব্যবস্থা ও বোনাসসহ ন্যায্যমজুরি নিশ্চিত করবে বাগান মালিক। বর্তমানে দেশে চা বাগানের সংখ্যা ১৬৮টি। যেখানে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৩৬৭ জন শ্রমিক কাজ করে।
প্রসঙ্গত, দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকার দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য গত বছর আগস্টে ধর্মঘটে নামেন চা শ্রমিকরা। ওই সময় সব চা বাগান অচল হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এরপর মালিকপক্ষের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর শ্রমিকদের ১৭০ টাকা মজুরি দিতে রাজি হন বাগান মালিকরা। এ প্রতিশ্রুতিতে ১৯ দিনের আন্দোলন প্রত্যাহার করে ওই বছরের ২৯ আগস্ট শ্রমিকরা কাজে ফিরে যান।
জানা গেছে, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মজুরি বোর্ড শাখা, সংশ্লিষ্ট মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধি, মজুরি বোর্ডের সদস্য, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে এ মজুরি ও স্কেল ঠিক করা হয়েছে। এর আগে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১৭০ টাকা নির্ধারণসহ আরও যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন সেগুলোও বহাল রাখা হয়েছে।
এজন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মজুরি বোর্ডের চেয়ারমান লিয়াকত আলী মোল্লার সভাপতিত্বে একাধিক বৈঠকে এটি চূড়ান্ত করা হয়।
নতুন মজুরি স্কেল অনুযায়ী-সব শ্রেণি বাগানের ইলেট্রিশিয়ান ও ড্রেসারে স্কেল ৮৬৫০ টাকা এবং সর্দার, মিস্ত্রি, লেদার অপারেটর, ধাই ও পিয়নের স্কেল ৮৫৫০ টাকা। স্থায়ী ও সাময়িক শ্রমিকদের সি শ্রেণির বাগানের মজুরি ১৬৮ টাকা, বি-শ্রেণির ১৬৯ টাকা এবং এ-শ্রেণির ১৭০ টাকা। এছাড়া হেডক্লার্ক স্কেল এ-শ্রেণির ১৬৯৩৬ টাকা, বি-শ্রেণির ১৬৪৬৫ কোটি টাকা ও সি শ্রেণির ১৫৮১৫ টাকা।
ক্লার্কের স্কেল এ-শ্রেণির ১৬৫১১ টাকা, বি-শ্রেণির ১৬১২৪ কোটি টাকা ও সি শ্রেণির ১৫৪৯৯ টাকা। হেড ফ্যাক্টরি ক্লার্ক স্কেল এ-শ্রেণির ১৬৩০৭ টাকা, বি-শ্রেণির ১৫৯১৫ কোটি টাকা ও সি শ্রেণির ১৫৩০৭ টাকা। আর হেড টিলা ক্লার্কের স্কেল এ-শ্রেণির ১৫৯১৫ টাকা, বি-শ্রেণির ১৫৪৪২ কোটি টাকা ও সি শ্রেণির ১৪৯১০ টাকা। সব চা বাগানের জন্য একই রেখে মেকানিকের স্কেল নির্ধারণ করা হয় ১৬৩৯৯ টাকা। আর সেকেন্ড অফিসার এবং স্টোর ক্লার্কের স্কেল এ-শ্রেণির ১৫৮৩১ টাকা, বি-শ্রেণির ১৫৩৯৯ কোটি টাকা ও সি শ্রেণির ১৪৮৭৭ টাকা। এ ছাড়া সেকেন্ড টিলা ক্লার্কের স্কেল এ-শ্রেণির ১৫২২১ টাকা, বি-শ্রেণির ১৪৮৩১ কোটি টাকা ও সি শ্রেণির ১৪৩৬৪ টাকা। থার্ড অফিস, টিলা ও ফ্যাক্টরি ক্লার্কের মজুরি স্কেল এ-শ্রেণির ১৫০০০ টাকা, বি-শ্রেণির ১৪৬২১ কোটি টাকা ও সি শ্রেণির ১৪২৮২ টাকা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্কুল মাস্টারের স্কেল এ-শ্রেণির ১৫৩৮৮ টাকা, বি-শ্রেণির ১৪৯৯৭ কোটি টাকা ও সি শ্রেণির ১৪৬১২ টাকা। আর প্রশিক্ষণবিহীন মাস্টার এবং কম্পাউন্ডারের স্কেল এ-শ্রেণির ১৫২২১ টাকা, বি-শ্রেণির ১৪৮৩১ কোটি টাকা ও সি শ্রেণির ১৪৩৮৫ টাকা। পাশাপাশি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কম্পউন্ডারের স্কেল এ-শ্রেণির ১৫৬২৫ টাকা, বি-শ্রেণির ১৫০৫৮ কোটি টাকা ও সি শ্রেণির ১৪৫৬২ টাকা।
ধাত্রী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং মেলেডিওলোজিস্ট স্কেল এ-শ্রেণির ১৫০০০ টাকা, বি-শ্রেণির ১৪৬১৭ কোটি টাকা ও সি শ্রেণির ১৪১৮৮ টাকা তবে মেলেডিওলোজিস্ট সি শ্রেণির ১৪১৯১ টাকা। ধাত্রী রেডক্রসে স্কেল এ-শ্রেণির ১৪৭৪১ টাকা, বি-শ্রেণির ১৪৩৮৫ কোটি টাকা ও সি শ্রেণির ১৪০৮১ টাকা।
শ্রম আইন-২০০৬ অনুযায়ী-চাকরি ন্যূনতম পাঁচ বছর পর প্রতি বছর চাকরির জন্য এক মাসের মূল বেতন গ্র্যাচুইটি হিসাবে প্রাপ্য হবেন। যারা বর্তমান পেনশন পাচ্ছেন তা বহাল থাকবে।
এ ছাড়া এক মাসের সমান বেতন হারে দুটি উৎসব ভাতা পাবেন। দৈনিক মজুরি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে উৎসব ভাতার পরিমাণ হবে ৪৭ দিনের মূল মজুরির সমান। মাতৃকালীন ছুটি থাকবে ১২০ দিনের।
সূত্র আরও জানায়, দেশের চা বাগানগুলোকে দুটি অঞ্চলে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার বাগানগুলোকে একটি অঞ্চলে ফেলা হয়। এ অঞ্চলের বাগানগুলো এ, বি ও সি তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়।
এর মধ্যে শ্রেণি-এ’র বাগান হলো-বছরে গড়ে এক লাখ ৮০ হাজার বা তার বেশি কিলোগ্রাম চা উৎপাদন করে। শ্রেণি-বি হলো-এক লাখ ৮ হাজার থেকে এক লাখ ৮০ হাজার কিলোগ্রামের ওপরের চা উৎপাদিত বাগান এবং সি-ক্যাটাগরি হলো-এক লাখ ৮ হাজার কিলোগ্রামের নিচে চা উৎপাদনকারী বাগান।
দ্বিতীয় অঞ্চলে ফেলা হয়েছে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও অন্যসব জেলার চা বাগান। এর মধ্যে শ্রেণি-এ’র বাগান হলো বছরে গড়ে এক লাখ ১৩ হাজার বা তার বেশি কিলোগ্রাম চা উৎপাদন করছে।
শ্রেণি-বি হচ্ছে ৪৫ হাজার থেকে এক লাখ ১৩ হাজার কিলোগ্রাম নিচে উৎপাদিত বাগান এবং সি-ক্যাটাগরি হচ্ছে ৪৫ হাজার কিলোগ্রামের নিচে চা উৎপাদনকারী বাগান।