২৩ নভেম্বর ২০২৪, শনিবার, ০৪:০৩:১৮ অপরাহ্ন
ব্রিটিশ আমলের ম্যাপ ধরে নির্ধারণ হবে ৫০০ নদ-নদীর সীমানা
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৮-০৮-২০২৩
ব্রিটিশ আমলের ম্যাপ ধরে নির্ধারণ হবে ৫০০ নদ-নদীর সীমানা

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের (এনআরসিসি) খসড়া তালিকায় দেশে নদ-নদী রয়েছে ৯০০-এরও বেশি। এর মধ্যে ১৮৮০ থেকে ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ সরকারের প্রস্তুতকৃত ম্যাপ (সিএস) অনুযায়ী ৫০০ নদ-নদীর সীমানা চিহ্নিতের উদ্যোগ নিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। আর এ কাজের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ)। উদ্যোগটির প্রশংসা করে নদীসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আরো আগেই এ ধরনের উদ্যোগ নেয়ার দরকার ছিল। পাশাপাশি সমীক্ষার কাজটি নির্ভুল ও দ্রুত সময়ে করারও আহ্বান তাদের।


 


নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৫০০টি নদ-নদীর সীমানা চিহ্নিত করার একটি প্রকল্প একনেকে পাস হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় দেশের নৌপথ সংরক্ষণের কাজ করে। এখন যদি নৌপথই না থাকে তাহলে সংরক্ষণ করব কী? আমার মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএর রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী নদী চিহ্নিত করাও আমাদের কাজ। সে অনুযায়ী দেশের ৫০০ নদ-নদী চিহ্নিত করার একটি প্রকল্প নিয়েছি।’


নদীর সীমানা নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করে মোস্তফা কামাল আরো বলেন, ‘সিএস ম্যাপ অনুযায়ী প্রত্যেক উপজেলার ম্যাপগুলো যুক্ত করে নদীর সীমানা চিহ্নিত করা হবে। যদি নদীর জায়গায় কোনো বাড়িঘর থাকে তা ভেঙে দিয়ে খনন করা হবে। সে যা-ই থাকুক না কেন নদী খনন করতেই হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মানুষের শরীরের শিরা-উপশিরা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, দেশের জন্য নদীও সে রকম গুরুত্বপূর্ণ। রক্তপ্রবাহ বন্ধ হলে যেমন মানুষ বাঁচে না, তেমনি নদী ভরাট হয়ে গেলে দেশও মরুভূমি হয়ে যাবে।’


বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, নদ-নদীর সীমানা নির্ধারণের বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হয়। দেশের ৫০০ নদ-নদীর সীমানা চিহ্নিত করার প্রকল্প বিআইডব্লিউটিএকে দেয়ার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে, যেখানে অন্যান্য স্টেকহোল্ডারও ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে এ সময় সবাই নিজেদের মতামত দেন। নদীর সীমানা নির্ধারণে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, জরিপ অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পরিবেশ অধিদপ্তর অল্পবিস্তর কাজ করেছে বলেও উল্লেখ করা হয় ওই বৈঠকে। তাই এ প্রকল্পের কাজে অন্যান্য সংস্থার প্রতিবেদনগুলো আমলে নেয়ার পরামর্শ দেন সভার সদস্যরা। কাজটি করতে গিয়ে কী কী জটিলতা তৈরি হতে পারে সে বিষয়েও আলোচনা হয় বলে জানা গেছে। 


নদ-নদীর সীমানা চিহ্নিত করার বিষয়টি একটি যুগোপযোগী উদ্যোগ বলে মন্তব্য করেছেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই একটি ভালো উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। দেশের অধিকাংশ নদ-নদীর সীমানা নির্ধারিত না থাকায় সরকারি ও বেসরকারি নানা কাজে জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। তাছাড়া সীমানা নির্ধারণ না থাকার সুযোগটি সবচেয়ে বেশি কাজে লাগাচ্ছে দখলদাররা।’


দেশের নদ-নদী দখলদারদের তালিকা তৈরিতে ২০১৭ সালের জুলাইয়ে তিন বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। সেই কাজ এখনো শেষ করা যায়নি। সিএস রেকর্ডে চিহ্নিত সব নদ-নদীর অবস্থান এখন আগের জায়গায় নেই জানিয়ে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, পানি আইনে নদীর সীমানা ও ফোরশোরকে সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। আবার আলোচিত প্রকল্পটিতে দখলদারদের চিহ্নিত করতে শুধু পানি আইন নয়, বন্দর আইন ও ভূমি আইনেরও সহায়তা নেয়া হয়েছিল। পাশাপাশি দখলদার চিহ্নিত করতে জিপিএস ব্যবহার ও সরজমিন পরিদর্শনও করা হয়েছিল। সব শেষে ৩৭ হাজার ৩৯৬ নদ-নদী দখলদারকে চিহ্নিতও করা হয়, যা পরবর্তী সময়ে নদী রক্ষা কমিশনের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো যাচাই না করেই সে তালিকা ওয়েবসাইট থেকে মুছে দেয়া হয়। এমনকি প্রকল্পের প্রতিবেদনও গ্রহণ করেনি কমিশন।


দখল রোধ ও বেদখল উচ্ছেদের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে নদীর সীমানা নির্ধারণ জরুরি উল্লেখ করে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘অবশ্যই নদীর সীমানা নির্ভুলিভাবে চিহ্নিত করতে হবে। এ কাজ করতে গিয়ে কোনো ধরনের বাধা কিংবা অনৈতিক সুবিধার কাছে মাথা নোয়ানো যাবে না। আমরা অতীতে দেখেছি, অনেক সময় প্রভাবশালীদের চাপে নদী কিংবা খালের সীমানা নির্ধারণে অথবা দখল উচ্ছেদে বেশ অনিয়ম করা হয়েছে। এ প্রকল্পে যেন সেসব বিষয়ের কোনো ছাপ না থাকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’  


দেশের সব নদ-নদীর তালিকা, বিভাগওয়ারি দখলদারদের তালিকা ও নদী দখলমুক্ত করতে সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে, সে সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের নদ-নদীর অভিভাবক এনআরসিসি। উচ্চ আদালতের ঘোষণায়ও এ কথা বলা হয়েছে। নদ-নদীর দখলদারদের চিহ্নিত করে তাদের উচ্ছেদের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে সুপারিশ করাই এনআরসিসির প্রধান কাজ। যদিও দেশের নদ-নদীর দখল ও দূষণ রোধে সংস্থাটির সফলতা প্রায় শূন্যের কোটায়। 


হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী দেশের সব নদ-নদীর সীমানাই সিএস ম্যাপ অনুযায়ী নির্ধারণ করার বিষয়ে জোর দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘শুধু ৫০০ নদ-নদীই নয়, দেশের সব নদীর সীমানাই সিএস অনুযায়ী চিহ্নিত করতে হবে। নদীর গতি পরিবর্তন করে ফেললে সেক্ষেত্রে আরএস বা বিআরএসের সর্বোচ্চ প্রবাহ ধরে সীমানা নির্ধারণ করতে হবে।’


প্রকল্প ব্যয় সম্পর্কে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘নদীর সীমানা নির্ধারণে যদি কোনো প্রকল্প নেয়া হয় তার ব্যয়ও যেন যুক্তিসংগত হয়। সরকারের অনেক দিনের অবহেলার ফলাফল হচ্ছে এত বেশি টাকা দিয়ে প্রকল্প গ্রহণ এবং শেষ পর্যন্ত তার আংশিক বাস্তবায়ন। এর আগেও আমরা দেখেছি, ঢাকা শহরের চারটা নদী—আজ পর্যন্ত তারই সীমানা সঠিকভাবে চিহ্নিত হয়নি। অথচ এ কাজের জন্য অনেক টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। তাই আমাদের দাবি থাকবে স্বল্প ব্যয়ে যেন এ কাজ বাস্তবায়ন হয়।’


শেয়ার করুন