২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০৯:০৭:৩৮ পূর্বাহ্ন
রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়: ডোপ টেস্টে পজেটিভ পিও‘র দাপট, মেয়াদ শেষেও অফিসে প্রকৌশলী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০১-০৯-২০২৩
রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়: ডোপ টেস্টে পজেটিভ পিও‘র দাপট, মেয়াদ শেষেও অফিসে প্রকৌশলী

সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী ডোপ টেস্টে (মাদক পরীক্ষা) কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী মাদকাসক্ত প্রমাণ হলে তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। তবে এই বিধি রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যক্তিগত কর্মকর্তার (পিও) ক্ষেত্রে সেটি প্রযোজ্য হয়নি। এমনকি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর মামলা চলমান থাকলেও তাঁকে সাময়িক বহিস্কার পর্যন্ত করা হয়নি। অপরদিকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ এক মাস আগেই অতিবাহিত হলেও এখনো অফিস করছেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিবির নেতা ওবাইদুল ইসলাম। এসব নিয়ে চরম ক্ষোভ বিস্তার করছে রামেবির অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে।


রাজশাহী নগরীর চন্দ্রিমা থানা সূত্র মতে, রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) নূর রায়হানকে মাদক সেবনের অভিযোগে (গাঁজা সেবন) গত ২১ সালের ৩০ মে গ্রেপ্তার করে নগরীর চন্দ্রিমা থানা পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর তাঁকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতেও প্রেরণ করা হয়। পওে আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান তিনি। এছাড়াও রামেবির রেজিস্ট্রারকে বিষয়টি অবগত করে একটি প্রতিবেদন দেন চন্দ্রিমা থানার এসআই ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পলাশ আলী। এছাড়াও পুলিশ রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নূও রাহয়ানের ডোপ টেস্ট করালে তাতেও তিনি পজেটিভ হন। ওই প্রতিবেদনের কপিও দেওয়া হয় রেজিস্ট্রারকে। দুটি প্রতিবেদন পাওয়ার পরেও রামেবি কর্তৃপক্ষ রহস্যজনকভাবে নূর রায়হানকে চাকরি থেকে সাময়িক বা স্থায়ী বহিস্কার না করে শুধুমাত্র কারণ দর্শানোর নোটিশ করে।


রামেবির তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ড. মো. খালেদ ২০২১ সালের ৫ জুন ওই কারণ দর্শানোর নোটিশটি করেন। ওই নোটিশের অভিযোগ নামার ১ নম্বরে উল্লেখ করা হয়, আপনি নূর রায়হান কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে ৩১ মে ২০২১ থেকে ১ জুন ২০২১ সাল পর্যন্ত অফিসে অনুপস্থিত ছিলেন। ২ নম্বরে বলা হয়, নূর রায়হানকে ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৬(১) টেবিলের ২১ ধারা অনুসারে অবৈধ মাদকদ্রব্য গাঁজা সেবন করার অপরাধে চন্দ্রিমা থানা পুলিশ গ্রেপ্তারের পর আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।


৩ নম্বরে বলা হয়, থানা কর্তৃক নুর রায়হানকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডোপ টেস্ট করানো হলে হাসপাতাল কর্তৃক চিকিৎসা প্রদানকৃত সনদপত্রে ক্যানেবাইস ইনটেক পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। ৪ নম্বরে বলা হয়, বিনা অনুমতিতে অফিসে অনুপস্থিত থেকে এবং অবৈধ গাঁজা সেবন কওে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা ২০১৮ এর ২(খ) অনুসারে ‘অসাদাচারণ’ এর অপরাধে লিপ্ত। পরিশেষে বলা হয়, আপনি যে অপরাধ করেছেন তার সর্বোচ্চ শাস্তি হচ্ছে উক্ত বিধি অনুসারে চাকরি হতে বরখাস্ত।


রামেবি সূত্র মতে, নূর রয়হানের মামলা এখনো চলমান। কিন্তু তার পরেও এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন ওই কর্মকর্তা। এমনকি বিভিন্ন নার্সিং কলেজ থেকেও তিনি প্রকাশ্যে ঘুষ নিয়েছেন বলেও দুটি ওডিও ক্লিপিও কালের কণ্ঠের হাতে এসে পৌঁছেছে।


তবে এসব বিষয়ে জানার জন্য নূর রায়হানকে বার বার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।


এদিকে, রামেবির পরিকল্পনা ও উন্নন দপ্তরের উপপরিচালক এসএম ওবায়দুল ইসলামের দ্বিতীয় মেয়াদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সময় শেষ হয়েছে গত ২৩ জুলাই। কিন্তু তিনি এখনো রামেবিতে অফিস করছেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং সরকারের গোপন নথি বাইরে পাচার হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সূত্র মতে, ওবায়দুল ইসলামকে প্রথমে ২০২২ সালের ২৪ জুলাই ৬ মাসের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় রামেবি কর্তৃপক্ষ। ওই মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি আবারও ৬ মাসের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ সম্পূর্ন স্থগিত রাখার একাধিক পরিপত্র জারি করা হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও এখনো অফিস করছেন ওই কর্মকর্তা। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে তাঁর বেতন ধরা হয় ৮৪ হাজার ২ টাকা। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত নিয়মিতি তিনি অফিস করেছেন।


অপরদিকে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র মতে, ওবায়দুল ইসলাম রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় থেকে পাশ করেন। তিনি রুয়েটে পড়া-শোনাকালীন ছিলেন সেখানকার শিবির নেতা। সেই সূত্রে পড়া-শোনা শেষ করে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও কারিগরি ওয়ার্কশপের প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি পান। তবে গত বছরের জানুয়ারিতে তিনি ডেপুটিশনে রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ে যোগদান করেন।


রামেবি সূত্র মতে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় পদ রেখে ক্ষমতার দাপটে তিনি রামেবিতে নিচু পদে যোগদান করেন মূলত টেন্ডার বাণিজ্য করার জন্য। রামেবির একটি আউটসোর্সিং টেন্ডারেও জালিয়াতিতে ছিলেন ওই কর্মকর্তা। পরে ঠিকাদারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সেই টেন্ডারটি বাতিল করা হয়। কিন্তু টেন্ডার টেম্পারিংয়ে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ওবায়দুল ইসলাম ওই টেন্ডার কমিটির সদস্য না হয়েও তিনি টেন্ডার ওপেনিংসহ সার্বিককাজে হস্তক্ষেপ করেছিলেন। তার ছবিও আছে কালের কণ্ঠের কাছে।


আরেকটি সূত্র জানায়, এই ওবাইদুলের রাজশাহী শহরে তিনটি বাড়ি। নগরীর ভদ্রা, নওদপাপাড়া এলাকায় দুটি বিশাল বাড়ি রয়েছে। অন্যটি রয়েছে কাজলা এলাকায়। অবৈধ অথৈর মাধ্যমে বিপুল সম্পদ গড়েছেন তিনি। রামেবিতে তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও তিনি অবৈধ অর্থের ধান্দায় এখনো বিশ^বিদ্যালয়ে যান না। রামেবিতেই অফিস করছেন অবৈধভাবে। অনেকটা জোর করেই রাবি ছেড়ে রামেবিতে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ নেরওয়া এবং ছুটি ছাড়ায় রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে দিনের পর দিন অনুপস্থিত থাকার পরেও ওবাইদুলের ক্ষমতার দাপটে তাঁর বিরুদ্ধে রাবি কর্তৃপক্ষও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।


জানতে চাইলে রামেবির সাবেক উপ-পরিচালক ওবায়দুল ইসলাম বলেন, ‘সেখানে চাকরি করেছি। তাই তাঁদের কোনো বিষয়ে প্রয়োজন হলে মাঝে মাঝে তো যেতেই হয়। এর বাইরে কিছুই না।’


জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ‘এই ধরনের অভিযোগ যদি থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট বিভাগে খোঁজ নিয়ে ওই কর্মকর্তার বিষয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জানতে চাইলে বেশ্বিবিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আনোয়ারুল কাদের বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের যা কিছু হয়, সিন্ডিকেটের অনুমোদনক্রমে। তার পরেও কিছু জানার থাকলে অফিসে আসেন সাক্ষাতে বলবো।’


এসব অনিয়ম বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য এ. জেড, এম মোস্তাক হোসেন বলেন, ‘এখানে আমার একার কোনো ক্ষমতা নাই। আমরা কোনো অনিয়মের সঙ্গেও জড়িত নয়। তবে কিছু অভিযোগ আছে, সেসব ক্ষতিয়ে দেখে পরবর্তিতে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে।’


প্রসঙ্গত, রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র মতে, রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এখানে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। যে সিন্ডিকেটের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসিও জিম্মি হয়ে পড়েন। আর ওই সিন্ডিকেটের কারণে ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভিন্ন খাতে ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকা তোছরুপ করা হয়েছে। যেগুলো নিয়ে বার বার বিশ্ববিদালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকেও আপত্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরেও থামেনি এসব অনিয়ম। সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে সাবেক প্রয়াত ভিসি মাসুম হাবিবের সময়ে। তাঁর সময়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা এখনো বহাল তবিয়তে। এমনকি একেক পরিবার থেকে ২-৩ জনকেউ চাকরি দেওয়া হয়েছে ওই সমেয়। তাঁরাও বেপরোয়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ে।


শেয়ার করুন