স্ত্রীর নামে ঢাকায় তিনটি ফ্ল্যাট ও তিনটা প্লট লিখে দিয়েছিলেন স্বামী। স্ত্রীর কাছে ছিল ৪০ ভরি সোনাও। কিন্তু তালাক হয়ে যায় তাঁদের। এরপর অপহরণের শিকার হন ওই নারী। তিনি মনে করছেন, ফ্ল্যাট-প্লট ও সোনার মালিকানা ফেরত পেতে সাবেক স্বামী হারুন অর রশিদই তাঁকে অপহরণ করেন।
ওই নারী জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার কর্মকর্তা। অপহরণের পর নির্যাতনের শিকার হয়ে পা ভাঙা নিয়ে এখনো বিছানাবন্দী তিনি।
অপহরণের পরিকল্পনাকারী সাবেক স্বামীর বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি এবং ওই ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামির জবানবন্দিতে নাম এলেও এখনো তাঁর খোঁজ করেনি পুলিশ।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, হারুন অর রশিদ সপ্তম বিসিএসের প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মকর্তা ছিলেন। সর্বশেষ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত সচিব পদে থেকে অবসরে যান। ঢাকায় দুটি বাসায় ঘুরে এবং ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি বলে সাবেক স্ত্রীর অভিযোগ সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য মেলেনি।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা নারী কর কর্মকর্তার এই মামলাটির তদন্ত করছেন রমনা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সহিদুল ওসমান মাসুম। তিনি গতকাল রোববার আজকের পত্রিকাকে বলেন, মামলার তদন্তকাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার আসামিদের একজন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তদন্তে যাঁর যাঁর নাম আসবে, তাঁকে আইনের আওতায় আনা হবে।
জিডি এবং আসামির জবানবন্দিতে নাম এলেও ওই নারীর সাবেক স্বামী হারুন অর রশিদের খোঁজ না নেওয়ার বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে চাননি তদন্ত কর্মকর্তা।
ওই নারীকে অপহরণের ঘটনায় র্যাব ও পুলিশের হাতে গাড়িচালক ও অপহরণকারী চক্রের হোতা সাবেক গাড়িচালক মাসুদসহ মোট ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। যাঁরা টাকার বিনিময়ে এই কাজ করেছিলেন।
গত ২৬ আগস্ট এজাহারভুক্ত তিন আসামিকে গ্রেপ্তারের পর র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গণমাধ্যমকে বলেন, এই অপহরণের নেপথ্যে ছিলেন ওই নারীর সাবেক স্বামী। সাবেক স্ত্রীর ওপর ক্ষোভ থেকেই অপহরণের পরিকল্পনা করা হয়।
মূল পরিকল্পনাকারী ওই ব্যক্তিকে আটকের বিষয়ে জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন আজকের পত্রিকাকে বলেন, মামলার এজাহারে তাঁর নাম নেই। তদন্ত সংস্থাকে বিষয়টি জানানো হয়েছে, পুলিশ এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে।
গত ১৭ আগস্ট রাত ৮টার দিকে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৯ নম্বর ফটকের সামনে থেকে অপহৃত হন ওই নারী কর্মকর্তা (৪৮)। তিনি মাইক্রোবাসে করে মগবাজার থেকে সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় ফেরার সময় কয়েকজন ব্যক্তি পথরোধ করে চালককে মারধর করেন। একপর্যায়ে তাঁরা চালককে নামিয়ে মাইক্রোবাসসহ ওই নারীকে অপহরণ করেন। উদ্ধারের পর ১৯ আগস্ট রমনা থানায় মামলা করেন তিনি।
অপহরণের নেপথ্যের কারণ হিসেবে পারিবারিক সূত্র বলছে, ১৯৯১ সালের দিকে হারুন অর রশিদের সঙ্গে বিয়ে হয় ওই নারী কর্মকর্তার। তখন তিনি এইচএসসিতে পড়তেন। বিয়ের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে এমএসসি পাস করে ২২তম বিসিএসে কাস্টমস ক্যাডারে যোগ দেন। তাঁদের তিন সন্তান রয়েছে। চাকরিজীবনে বিভিন্ন পর্যায়ে হারুন অর রশিদ স্ত্রীর নামে তিনটি ফ্ল্যাট ও তিনটি প্লটসহ অন্তত ৪০ ভরি গয়না দিয়েছিলেন।
সূত্রটি বলছে, অবসরে যাওয়ার আগেই বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন হারুন অর রশিদ। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা পাশাপাশি ফ্ল্যাটে আলাদাও থাকছিলেন। নানা বিষয় নিয়ে কথা-কাটাকাটির পর মারামারিও হতো তাঁদের মধ্যে। পরে ২০২১ সালে এই নারী নিজে থেকেই তালাক দেন স্বামীকে।
তালাকের পর ইলিয়াস খান নামের এক বন্ধুকে বিয়ে করেন ওই নারী। ইলিয়াস খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, তিনি আর তাঁর বর্তমান স্ত্রী (কর কর্মকর্তা) বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের বন্ধু। সংস্কৃতিমনা দুজন একসঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করেছেন। ২০১৭ সালে তাঁর প্রথম স্ত্রী ক্যানসারে মারা গেলে ২০২২ সালে ডিসেম্বরে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন। অবশ্য তার আগে থেকেই সুসম্পর্ক ছিল তাঁদের, যা মেনে নিতে পারতেন না সাবেক আমলা হারুন।
ইলিয়াস খানের দাবি, বিয়ের পর থেকেই বিভিন্ন অশান্তির চেষ্টা করছিলেন তাঁর স্ত্রীর সাবেক স্বামী হারুন। তিনি চেয়েছিলেন, যেহেতু তাঁকে তালাক দিয়েছেন তাই তাঁর দেওয়া সম্পত্তি তাঁকে ফেরত দেওয়া হোক। কিন্তু সেটা না দেওয়ায় সাবেক গাড়িচালককে হাত করে সাবেক স্ত্রীকে অপহরণ করেন হারুন।
জানতে চাইলে ওই নারী কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, তদন্তে যাঁদের নাম আসবে, তাঁদের সবাইকে যেন বিচারের আওতায় আনা হয়। কাউকে যেন ছাড় দেওয়া না হয়।