২৩ নভেম্বর ২০২৪, শনিবার, ০৫:৩৯:১৪ অপরাহ্ন
নিয়ন্ত্রকও মানছে না ওষুধের দাম বাড়ানোর আইন
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-০৯-২০২৩
নিয়ন্ত্রকও মানছে না ওষুধের দাম বাড়ানোর আইন

একসময় দুই শর বেশি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দিত সরকার, এখন ঠিক করতে পারে মাত্র ১১৭টির। এ ক্ষেত্রে কিছু আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণের বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু তা-ও মানছে না ওষুধ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।


১৯৮২ সালের ঔষধ (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশের  ১১(১) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, ‘সরকার অফিশিয়াল গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে ওষুধের দাম নির্ধারণ করতে পারবে।’ আইনের এই ধারা অমান্য করে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ওষুধের দাম বাড়িয়ে চলেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। ২০২২ সালে এভাবে দুবার ওষুধের দাম বাড়িয়েছে সংস্থাটি।


ওষুধের দাম বাড়িয়ে প্রথম প্রজ্ঞাপনটি প্রকাশ করা হয় গত বছরের ২০ জুলাই। সেই প্রজ্ঞাপনে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বহুল ব্যবহৃত ২০টি জেনেরিকের ৫৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়। এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন মাত্রার প্যারাসিটামলের দাম বাড়ানো হয় ৫০ থেকে শতভাগ। ৪০ টাকার অ্যামোক্সিসিলিনের দাম বাড়িয়ে করা হয় ৭০ টাকা এবং ২৪ টাকার ইনজেকশন হয়ে যায় ৫৫ টাকা।


ওষুধের দাম বাড়াতে দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয় গত বছরের ৪ ডিসেম্বর। সেই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২৪টি ওষুধের দাম বাড়ায় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।  শুধু তা-ই নয়, প্রজ্ঞাপন ডিসেম্বরে জারি করা হলেও মূল্য কার্যকর হয়েছে এরও আগে, ২০ নভেম্বর থেকে।


গেজেট প্রকাশ না করে এভাবে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে ওষুধের দাম বাড়ানোটা বেআইনি বলে জানিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। এ বিষয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিতভাবে অভিযোগ দিয়েছে সংগঠনটি। এতে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধিসংক্রান্ত ১০টি অসংগতি তুলে ধরা হয়।


ক্যাব জানায়,  দেশে উৎপাদিত এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় ব্যবহৃত ১১৭টি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে সরকার। আইন অনুসারে প্রতিটি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই এই তালিকার ৬০টি ওষুধ উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু বেশির ভাগ উৎপাদনকারীই এর মধ্যে অল্প কয়েকটি ওষুধ উৎপাদন করে। এই ১১৭টির বাইরে অন্য সব ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো, যা ১৯৮২ সালের ঔষধ (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশের ১১(১) ধারার লঙ্ঘন বলে মনে করে ক্যাব।


২০২২ সালের ২০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ওষুধের মূল্য নির্ধারণ কমিটির সভায় উপস্থাপন করা দাম প্রস্তাবে দেখা যায়, উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে মার্ক-আপ ফ্যাক্টর ৩ দশমিক ৪০ গুণ করে ওষুধের মূল্য নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ওষুধের দাম যতটা বাড়ায়, তার ৩ দশমিক ৪০ গুণ বেশি দাম বাড়ায় মার্ক-আপ ফ্যাক্টর। এই ফ্যাক্টর নির্ধারণে কোনো আইনগত ভিত্তি পাওয়া যায়নি বলেও জানিয়েছে ক্যাব।


ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় আইন লঙ্ঘন হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, আইন অনুযায়ী ওষুধের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা সরকারের। তবে দাম বাড়াতে হলে বাজার যাচাই করতে হবে, বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ করতে হবে এবং গণশুনানি করতে হবে। তিনি আরও বলেন, প্রাণরক্ষাকারী অনেক ওষুধের দাম সরকার নির্ধারণ না করে ওষুধ কোম্পানিগুলো নির্ধারণ করছে। কোম্পানিগুলো এ ক্ষেত্রে যদি এক টাকাও দাম বাড়ায়, আর সেটা যদি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর মেনে নেয়, তা হবে বেআইনি। ওষুধ কোম্পানির প্রস্তাবিত দাম গ্রহণের এখতিয়ার ঔষধ প্রশাসনের নেই।


জানা গেছে, ওষুধের দাম নিয়ে গত ২৮ আগস্ট প্রতিযোগিতা কমিশনে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ঔষধ প্রশাসনসহ সব অংশীজনের প্রতিনিধি থাকলেও ওষুধের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার বিষয়ে সদুত্তর দেননি কেউ। সেখানে দাম কমানোর বিষয়ে কোনো ফলপ্রসূ আলোচনা হয়নি।


এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আসরাফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের পক্ষে দাম কমানোর সুযোগ নেই। প্রতিযোগিতা কমিশন থেকে কোনো প্রস্তাবনা এলে সেটা বিবেচনা করা হবে।’


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধের দাম কোম্পানিগুলো ইচ্ছেমতো বাড়ালেও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর নীরব ভূমিকা পালন করে। সম্প্রতি দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বাড়লে কোম্পানিগুলো বিভিন্ন ধরনের স্যালাইনের দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রেও ঔষধ প্রশাসনের ভূমিকা জনগণের বিপক্ষে অবস্থানের শামিল।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, ‘দেশের একমাত্র উৎপাদিত পণ্য ওষুধ, যার দাম নির্ধারণ করে কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসনের সিদ্ধান্তই আমাদের সিদ্ধান্ত।’


তবে ইনসেপ্‌টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মুক্তাদির বলেন, ‘৮৬ টাকার ডলার এখন ১১৭ টাকা। সে হিসাবে পণ্যের দাম আরও বাড়ার কথা। আমরা এখনো দাম বাড়াইনি, তবে অদূর ভবিষ্যতে বাড়াতে হবে।’


জাতীয় ভোক্তা অভিযোগ নিষ্পত্তি কমিটির সদস্যসচিব আলমগীর কবির বলেন, ‘আমরা নিয়ম অনুযায়ী ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এ ছাড়া আইনজীবীর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ-সংক্রান্ত আইনি নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তারা বিষয়টি সুরাহা না করলে আমরা আদালতের আশ্রয় নেব। জনগণের জীবন নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেলতে দেওয়া যায় না।’


১৯৮২ সালের অধ্যাদেশে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ছিল সরকারের। কিন্তু ১৯৯৪ সালে মাত্র ১১৭টি ওষুধের দাম সরকারের হাতে এবং বাকিগুলো কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হয়। তখন থেকেই এ খাতে নৈরাজ্য শুরু হয় বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের সাবেক ডিন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। তিনি বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো ১৯৯৪ সালে নেওয়া সিদ্ধান্তের সুবিধা নিচ্ছে। এটা পরিবর্তনে কেউ এগিয়ে আসে না। যেহেতু সব কাঁচামাল আমদানি করতে হয়, তাই ডলারের দামের সঙ্গে ওষুধের দাম বাড়ে। দেশে এপিআই পার্ক চালু না হওয়া পর্যন্ত ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে।


শেয়ার করুন