সরকারের অন্যতম মেগা প্রকল্প খুলনা-মোংলা রেললাইন নির্মাণকাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ কাজের অগ্রগতি ৯৭ দশমিক ৫ শতাংশ দাবি করলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। কাজ শেষ করার তোড়জোড় থাকলেও এখনো বেশ কিছু স্থানে রেললাইনের কাজ শেষ হয়নি। তিনটি সেতুতে কাজ চলছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে ও প্রকল্প কর্তৃপক্ষ বলছে, নিম্নাঞ্চল হওয়ায় মাটিতে সমস্যার কারণে সময় বেশি লাগছে। এ ছাড়া বৃষ্টিও কাজের গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। এসব কারণে চলতি মাসে উদ্বোধনের কথা থাকলেও এটি পিছিয়ে আগামী মাসে অর্থাৎ অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে যেতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ খুলনা-মোংলা রেললাইনের নির্মাণকাজ তিন বছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রায় ১৩ বছরেও হয়নি। পাঁচ দফা সময় বেড়ে চলতি সেপ্টেম্বরে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা।
অগ্রগতি না হওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ দুষছে নরম মাটিকে। খরচও বেড়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। সংযোগ লাইনসহ এই রেলপথের মোট দৈর্ঘ্য ৯১ কিলোমিটার। উদ্বোধনের জন্য এখন কাজের গতি বাড়লেও এই পথে ট্রেন চলতে তিন মাস লাগতে পারে বলে মত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তার।
এই রেললাইনে কিছু সমস্যা ধরা পড়ার কথা রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনও সম্প্রতি আজকের পত্রিকাকে জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটি ঠিক করতে সময় লাগবে। অবশ্য প্রকল্প পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান বলেছেন, তাঁরা অক্টোবরের মধ্যেই এই রেললাইনে পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেন চালানোর ব্যাপারে আশাবাদী।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোংলা বন্দরে পণ্য পরিবহনে গতিশীলতা বাড়াতে এবং প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল ও ভুটানের পণ্য পরিবহনের কেন্দ্র করতে সরকার খুলনা-মোংলা রেলসংযোগ প্রকল্প হাতে নেয়। প্রথমে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৮০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর। কথা ছিল, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ হবে। কিন্তু কাজের অগ্রগতি না হওয়ায় প্রথমে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এরপর মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত। তৃতীয় দফায় আবার দুই বছর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না হওয়ায় ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়।
সর্বশেষ পঞ্চম ধাপে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ধরা হয়েছে। তবে নির্মাণকাজ শেষ করার মেয়াদ চলতি সেপ্টেম্বরে। বাকি এক বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের ‘ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড’ হিসেবে ধরা আছে। প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬০ কোটি ৮৮ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। এতে করে সংযোগ লাইনসহ ৯১ কিলোমিটার রেললাইনের জন্য প্রতি কিলোমিটারে খরচ হচ্ছে ৪৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা।
ভারত সরকারের ঋণ সহায়তা চুক্তির আওতায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান লার্সেন অ্যান্ড টুব্রো। ট্র্যাক সংযোগ করছে আরেক ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইরকন ইন্টারন্যাশনাল।
ঠিকাদার সূত্র জানায়, এই রেললাইনে রূপসা সেতুসহ ২১টি সেতু ও ১১০টি কালভার্ট রয়েছে। এগুলোর আশপাশের মাটিতে সমস্যা ছিল; বিশেষ করে জলাভূমি হওয়ায় মাটি দেবে যায়। এর মধ্যে ফুলতলা সেতুতে সর্বশেষ এমন সমস্যা ছিল।
এ ছাড়া প্রকল্প এলাকার নরম মাটির জন্য নকশা পর্যালোচনাকেও বিলম্বের অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। এই পথে আটটি স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো হলো ফুলতলা, আড়ংঘাটা, মোহম্মদনগর, কাটাখালী, চুলকাটী, ভাগা, দিগরাজ ও মোংলা রেলওয়ে স্টেশন।
গত বুধবার খুলনার আড়ংঘাটা ও ফুলতলা স্টেশন ঘুরে দেখা যায়, এখনো রেললাইনের সব কাজ শেষ হয়নি। নতুন নির্মিত আড়ংঘাটা স্টেশনে যাওয়ার সড়কে পিচ ঢালাই হয়নি। স্টেশন ভবনের ফটক তালাবদ্ধ। দুটি জানালার কাচ ভাঙা। রেললাইনে পাথর দেওয়া শেষ হয়নি। ট্র্যাকের সঙ্গে সংযোগ বাকি। ফুলতলা স্টেশন আগেই ছিল। এই স্টেশনে আলাদা রেললাইন করা হয়েছে। লাইনের পাতে ঢালাইয়ের সঙ্গে ট্র্যাক লাগানো হয়নি। লাইনে দেওয়ার জন্য পাশেই পাথর স্তূপ করে রাখা হয়েছে।
খুলনা অংশে প্রকল্পের কাজ তত্ত্বাবধানকারী ইরকনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, অক্টোবর উদ্বোধন করা হলেও এই পথে ট্রেন চলতে আরও তিন মাস লাগবে। এ জন্য কর্মীর সংখ্যাও অনেক বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, এখন মোংলা অংশে কাজ বেশি হচ্ছে। কারণ, উদ্বোধনের জন্য ওই অংশে প্রস্তুত করা হচ্ছে।
কাটাখালী থেকে মোংলা স্টেশন পর্যন্ত কাজের তোড়জোড় বেশি। সেপ্টেম্বর ধরেই কাজ এগোনো হচ্ছিল। তবে সমস্যা বেশি হওয়ায় সময় বাড়ানো হয়েছে। মোংলার বাইরে অনেক জায়গায় রেলের ট্র্যাক বসানো ও পাথর ফেলার কাজ চলছে।
কয়েকটি সেতুকে এই রেললাইনের প্রধান সমস্যা উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, লতা, বরইতলা ও আড়ংঘাটা অংশে ৫, ৬ ও ৯ নম্বর সেতুতে কাজ চলছে। সেখানে মাটিতে সমস্যা রয়েছে। এখানে রেললাইন যাচ্ছে বিলের মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন, সময় বেশি পেলে কাজও ভালো হবে।
ঠিকাদার সূত্রে জানা যায়, গত দুই বছরে প্রকল্প এলাকা থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকার সরঞ্জাম চুরি হয়েছে। এর বেশির ভাগই রেললাইনের সঙ্গে লাগানো থাকা ক্লিপ। যার একেকটির দাম ১ হাজার টাকা। এভাবে চুরির কারণে কাজে সমস্যা হয়। কিন্তু চুরির বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, চুরির বিষয়ে স্থানীয় থানা ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে। চুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না। যারা ধরা পড়ছে, তারা অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে ছেড়ে দিতে হচ্ছে। ঠিকাদার এই অভিযোগ করলেও এর দায় বাংলাদেশ রেলওয়ের বা সরকারের নয়।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, খুলনা থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হচ্ছে খুলনার রূপসা ও বাগেরহাটের পশুর নদের অববাহিকায় জেগে ওঠা ভূমির ওপর দিয়ে। এ কারণে এই অঞ্চলের মাটির গঠন শক্তিশালী নয়। ফলে ভারী রেলপথের কারণে কিছু অংশে দেবে গেছে। রেলপথ সমান্তরাল না হলে চলাচল উপযোগী হয় না। তাই এখন মাটি, বালু, ইটের খোয়া ফেলে দেবে যাওয়া অংশ সমান্তরাল করার কাজ চলছে। সব দেখে মনে হয়েছে, আগামী এক থেকে দুই মাসের মধ্যে কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না।