২৪ নভেম্বর ২০২৪, রবিবার, ১০:৩৬:১৮ পূর্বাহ্ন
নির্বাচনে বিএনপি আসুক বা না আসুক—বিকল্প রেখে আওয়ামী লীগের ভোটের ছক
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-০৯-২০২৩
নির্বাচনে বিএনপি আসুক বা না আসুক—বিকল্প রেখে আওয়ামী লীগের ভোটের ছক

সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোটের এক দফা দাবিতে আন্দোলনের টানা কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। ওই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর চাপও আছে। এর মধ্যেই সংবিধানের আওতায় থেকে ওই নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য জোরেশোরে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।


বাইরের চাপ ও বিরোধীদের আন্দোলনের কারণে এবারের নির্বাচন দলের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিতে পারে বলে বেশ আগে থেকে বলে আসছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তবে দলের নেতারা বলছেন, চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে বিএনপি এবারের নির্বাচনে আসতে পারে, এবং না-ও আসতে পারে। উভয় পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে আওয়ামী লীগ।


প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় দলীয় চেয়ারম্যান ও তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে গণভবনে বৈঠক শুরু করেছেন শেখ হাসিনা। এরই মধ্যে তিনি নিজে ভোট প্রার্থনা শুরু করেছেন। আর আগামী অক্টোবর থেকে জেলায় জেলায় নির্বাচনী জনসভার প্রস্তুতি নিচ্ছে দল।


দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ আজকের পত্রিকাকে বলেন, আগামী নির্বাচন পর্যন্ত সারা দেশে ধারাবাহিক বিভিন্ন কর্মসূচি থাকবে। 


মনোনয়নপ্রত্যাশীরা ব্যস্ত তদবির-গণসংযোগে

নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হতে আগ্রহীরা এরই মধ্যে মনোনয়ন পেতে বিভিন্ন পর্যায়ে তদবির শুরু করেছেন। আর আসনে আসনে শুরু হয়েছে গণসংযোগ। অনেক জেলা-উপজেলায় পাল্টাপাল্টি প্রচারে সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে।


তবে এবার মুখ দেখে নয়, জরিপের ভিত্তিতে সাংগঠনিকভাবে দক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়ার কথা নেতাদের বলে দেওয়া হয়েছে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে।


প্রার্থিতার বিষয়ে দলের সভাপতি-মণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ আজকের পত্রিকাকে বলেন, এলাকায় যাঁদের জনপ্রিয়তা ও সুনাম আছে, তাঁরাই মনোনয়ন পাবেন। 


কেন্দ্রে ভোটার টানা

বিএনপি এবার ভোটে না এলেও নির্বাচন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় এবং বিগত দুবারের তুলনায় বেশি ভোটার উপস্থিতি হয়, সে জন্য এখন থেকেই পরিকল্পনা নিচ্ছে ক্ষমতাসীনেরা।


দলের সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা আজকের পত্রিকাকে বলেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়ে যাবে। ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে এখন থেকে কেন্দ্রভিত্তিক কাজ শুরু হয়েছে। ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রে এলে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে।


সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার

ভোটের প্রথাগত প্রচারের বাইরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারের কৌশল নির্ধারণ করছে দলটি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) নানান কর্মশালার আয়োজন করছে ধারাবাহিকভাবে। সেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামে গত ১৫ বছরের অর্জনগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। একই সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ব্যর্থতাগুলোও তুলে ধরা হবে।


কাজী জাফর উল্যাহ আজকের পত্রিকাকে বলেন, নির্বাচনে আগ্রহীরা পুরোদমে মাঠেই আছেন। তাঁরা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ-গণসংযোগ করছেন।


নির্বাচনের প্রচার কৌশল নিয়ে প্রস্তুতি শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। দলটির প্রচারকর্মীরা এবার দেশের ঘরে ঘরে প্রত্যেক ভোটারের কাছে নির্বাচনী বার্তা পৌঁছাতে চান। এ জন্য এলাকাভিত্তিক প্রচারকারী মনোনীত করবে ক্ষমতাসীনেরা। তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করা হচ্ছে। গতকাল দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মাস্টার ট্রেইনারদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। 


প্রস্তুত হচ্ছে নির্বাচন কমিশন

নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান বলেছেন, নির্বাচনী রোডম্যাপ ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। সংবিধান অনুযায়ী কমিশন যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগামী নভেম্বরের মাঝামাঝি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে বলে কমিশনের কর্মকর্তারা জানান।


নির্বাচন সামনে রেখে মাঠ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের আগেভাগেই প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এরই অংশ হিসেবে ১ অক্টোবর থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করতে চায় কমিশন। এরপর ধাপে ধাপে বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার, ডিসি, পুলিশ সুপারদের এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। 


বিএনপির বিকল্পের খোঁজে

শেষ পর্যন্ত বিএনপি ভোটে না এলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আমেজ তৈরি, ভোটারের উপস্থিতি বাড়ানো এবং নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে বিকল্প কী কৌশল নেওয়া যায়, তা-ও খতিয়ে দেখছেন ক্ষমতাসীনদের কৌশলবিদেরা।


অসুস্থতার জন্য এবারের ভোটে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রত্যক্ষ ভূমিকার সম্ভাবনা না থাকায় দলটির পুরো কৌশল নির্ধারিত হয় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্তে। এমন পরিস্থিতিতে তারেক রহমানের আস্থায় নেই, দলের এমন সুপরিচিত নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগও শুরু হয়েছেন সরকারের লোকেরা।


বিএনপি প্রভাবিত সংসদীয় আসনগুলোয় দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই এমন সুপরিচিত নেতা ও দলটির সাবেক সংসদ সদস্য কোনো না কোনো নিবন্ধিত দলের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের মাঠে নামানোর প্রস্তুতিও চলছে।


খালেদা জিয়ার সরকারের সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার তৈরি ‘তৃণমূল বিএনপি’তে দলের অন্য দুই সাবেক নেতা সমশের মবিন চৌধুরী ও তৈমূর আলম খন্দকারের যোগদান এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা।


এই দুই নেতার তৃণমূলে যোগ দিতে যাওয়ার খবর গতকাল বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের নেতা তৈমূর আলম খন্দকার গণমাধ্যমকে বলেছেন, বিএনপির পক্ষ থেকে তাঁর কোনো খোঁজখবর নেওয়া হয় না। নেওয়া হবে এমন আশাও তিনি দেখছেন না। তাই তিনি বাধ্য হয়ে বিএনপি ছাড়ছেন।


তবে দলের নেতৃত্বের প্রতি নিজের ক্ষোভও গোপন রাখেননি তৈমূর আলম। বলেছেন, কোনো দলেরই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হওয়া উচিত নয়। 


ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-চীন

বিরোধী বিএনপিসহ প্রধান দলগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন কী করে হতে পারে, সে বিষয়ে বাংলাদেশের নিকট বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র।


আমেরিকাবিরোধী কৌশলের কারণে চীন এরই মধ্যে বর্তমান সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এতে বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে নিজস্ব অবস্থান ঠিক করা ভারতের জন্য সহজ হয়ে গেছে বলে মনে করছে কূটনৈতিক সূত্রগুলো।


ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা সম্প্রতি বলেছেন, ভারত নিজের স্বার্থে বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা চায়। বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের কৌশলবিদেরা মনে করেন, ২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভারতের উদ্বেগ দূর করেছে। তৈরি হয়েছে বহুমুখী যুক্ততার সুযোগ। এমন অবস্থায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি ভারতের সমর্থনের ক্ষেত্রে কোনো রাখঢাক রাখেনি দেশটির সরকার।


বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন, এমন একজন কূটনীতিক আজকের পত্রিকাকে জানান, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো সমর্থন করুক বা না করুক, নির্ধারিত সময়ে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে এগোতে শেখ হাসিনাকে সবুজ সংকেত দিয়েছে ভারত।


অন্যদিকে সংবিধানের আওতার মধ্যেই বিরোধী বিএনপিসহ প্রধান দলগুলোকে নির্বাচনে আসার জন্য সুযোগ তৈরি করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বলে দেশটির একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়। 


সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স

মার্কিন কূটনৈতিক একটি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, সংবিধানের আওতায় সম্ভব না হলে প্রয়োজনে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংবিধানের বাইরে গিয়ে হলেও অন্তর্বর্তী কোনো ব্যবস্থার সন্ধান মেলে কি না, তা নিয়েও কথা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে।


২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এক সংক্ষিপ্ত রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা-সম্পর্কিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন। তবে একই সঙ্গে রায়ে শান্তিশৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতার স্বার্থে পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলে আপিল বিভাগ মত দেন।


সংবিধান বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, আপিল বিভাগ ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। এই রায় প্রকাশের আগেই সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়ার পর রায়টি পুনর্বিবেচনার বিষয়টি আদালতে তোলা হয়নি। তাই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে সংবিধান সংশোধন করা হলেও রায়টি পুনর্বিবেচনার আইনি সুযোগ থাকলেও থাকতে পারে।


এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক আজকের পত্রিকাকে বলেন, যখন সাহাবুদ্দীন আহমদ প্রধান বিচারপতি ছিলেন, তখন কি কেউ বলত, তিনি দেশের দায়িত্ব নেবেন? আর নির্বাচন করে প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যাবেন?


কথার কথা, যদি রাজনৈতিক দলগুলো বলে, এক বছর পরে নির্বাচন হবে। সে ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচন এক বছর পেছানো যায়। আপাতত যেভাবে আছে, সেভাবে সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য হলে এবং নতুন ব্যবস্থা এলে এর সাংবিধানিক রূপ দেওয়া সম্ভব। রাজনৈতিক সমঝোতা হলে যেকোনো কিছুই সম্ভব।


শেয়ার করুন