শাহবাগ থানায় দুই ছাত্রলীগ নেতাকে মারধরের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি অভিযুক্তদের চাকরিজীবনের আমলনামা খুঁজছে। বিশেষ করে এ সংক্রান্ত গোপনীয় নথিতে তাদের বিরুদ্ধে কোনো বিরূপ মন্তব্য, অপরাধ, শাস্তি এবং শাস্তির পরিমাণসহ নেতিবাচক কিছু রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এজন্য এ ঘটনায় অভিযুক্ত অন্তত অর্ধডজন ব্যক্তির প্রিভিয়াস কনভিকশন অ্যান্ড প্রিভিয়াস রেকর্ড (পিসিপিআর) ও পার্সোনাল ডেটা শিট (পিডিএস) সংগ্রহ করছে তদন্ত কমিটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব কারণে ২৪ দিনেও প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হয়নি।
রোববার সন্ধ্যায় ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক যুগান্তরকে বলেন, কমিটি এখনো প্রতিবেদন দেয়নি। তারা আরও সময় চেয়েছে।
সূত্র বলছে, বেঁধে দেওয়া সময় অনুযায়ী রোববার তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা তা দিতে পারেনি। এর আগে দুই দফা সময় বৃদ্ধি করা হয়। তদন্তকাজ সম্পন্ন করতে কমিটি নতুন করে আরও সাত কার্যদিবস সময় চেয়েছে। তদের তিন কার্যদিবস সময় দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কমিটি ৯০ ভাগের বেশি কাজ শেষ করেছে। তবে প্রক্রিয়াগত কিছু কাজ সম্পন্ন করাসহ প্রকৃত ঘটনা সঠিকভাবে উদ্ঘাটন করে অভিযুক্তদের সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে আরও কিছুটা সময় লাগছে।
৯ সেপ্টেম্বর রাতে শাহবাগ থানায় ছাত্রলীগের দুই নেতাকে নির্মম নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে রমনা জোনের তৎকালীন এডিসি হারুন-অর-রশিদসহ ১০-১৫ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। নির্যাতিতদের অভিযোগ, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক খান মামুনের স্ত্রী সানজিদা আফরিনের সঙ্গে হারুনকে দেখে ফেলেন তারা। এরই জেরে থানা হেফাজতে তাদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়। এ ঘটনার পরদিন যুগান্তরের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে ডিএমপি। কমিটিকে দুই কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। পরে আরও পাঁচ কার্যদিবস সময় দেওয়া হয়। এই সময়ে প্রতিবেদন দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তিন কার্যদিবস সময় বাড়ানো হয়। রোববার তাদের প্রতিবেদন দেওয়ার কথা ছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, তদন্ত কমিটির কাছে থানায় নির্মমতা এবং এর আগে-পরের ঘটনা তুলে ধরে বক্তব্য দেন ৪০-৪২ জন। এর পাশাপাশি তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বিভিন্ন ব্যক্তির বিষয়ে জানতে অফিশিয়াল চ্যানেলে বেশকিছু চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর অনেক জবাব নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আসেনি। তাদের চাকরিজীবনের সার্বিক মূল্যায়নসংক্রান্ত তথ্য হাতে পাওয়ার পর প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্তসংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরের কাছে দাবি করেন, সর্বোচ্চ স্বচ্ছতার সঙ্গে তদন্ত চলছে। এজন্য পিসিপিআর ও পিডিএস সংগ্রহ করা হচ্ছে। পিসিপিআর-এ আগের মামলার পরিসংখ্যান এবং পিডিএস-এ চাকরিজীবনের বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ থাকে। উল্লিখিত দুটি বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য যত দ্রুত পাওয়া যাবে, তত তাড়াতাড়ি প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হবে।
এদিকে অপর একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বাস্তবে এগুলো আইওয়াশ ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, এডিসি হারুনরা এতটাই প্রভাবশালী কর্মকর্তা ছিলেন যে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা তো দূরের কথা, তাদের এসিআর বা চাকরির পারফরম্যান্স-সংক্রান্ত গোপনীয় প্রতিবেদনে কেউ বিরূপ মন্তব্য করার সাহস দেখাননি। বরং সর্বোচ্চ নম্বর দিয়ে নিজেরা ধন্যবাদ পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। ফলে সত্যিই যদি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চায়, তাহলে এত বাহানা করার দরকার নেই। এরা তো অলরেডি বড় ধরনের ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩-এর ধারায় সংশ্লিষ্ট মামলা করার সুযোগ রয়েছে। তদন্ত কমিটি প্রকাশ্য প্রমাণিত অপরাধ উল্লেখ করে বিভাগীয় মামলা দায়ের ছাড়াও এ আইনে মামলার সুপারিশ করতে পারে। এছাড়া এতদিন তাদের দ্বারা যারা হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের বিষয়গুলোও বিভাগীয় মামলায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলতে পারে। মূলত সদিচ্ছা থাকলে এ বিষয়ে তদন্ত শেষ করতে বড়জোর সাত দিন লাগার কথা। কেননা এটি কোনো ক্লুলেস ঘটনা নয়। যা ঘটেছে, পুরো জাতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রত্যক্ষ করেছে।
এর আগে তদন্ত কমিটির কাছে এডিসি হারুন-সানজিদার পাশাপাশি শাহবাগ থানার তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক মো. গোলাম মোস্তফাসহ ছাত্রলীগের ভুক্তভোগী নেতা এবং ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও থানার প্রত্যক্ষদর্শীরা ঘটনার বর্ণনা দেন। লিখিত বক্তব্য দেন রাষ্ট্রপতির এপিএস মামুন। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, তাদের প্রায় সবার জবানিতে হারুনের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। এর পাশাপাশি পরিদর্শক মোস্তফার আগ্রাসী ভূমিকার বিষয়টিও এসেছে। যে ৪০-৪২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে, ঘটনায় সম্পৃক্ততা নিরূপণে তাদের বক্তব্যও বিশ্লেষণ করে তদন্ত প্রতিবেদনে প্রয়োজনীয় মতামত তুলে ধরা হচ্ছে। এ ঘটনায় এডিসি হারুনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে। ইতোমধ্যে সাংবাদিকদের কাছে এমন তথ্য জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
এদিকে ১০ সেপ্টেম্বর এডিসি হারুনকে রমনা জোন থেকে প্রত্যাহার করে ডিএমপির পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (পিওএম) সংযুক্ত করা হয়। আবার সেদিন রাতেই তাকে এপিবিএন-এ বদলি করা হয়। এ নিয়ে আপত্তি উঠলে সাময়িক বরখাস্ত করে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। এতেও বাদ সাধেন ছাত্রলীগ নেতারা। এরপর সবশেষ তাকে ১২ সেপ্টেম্বর রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়। গত সপ্তাহে তিনি রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে যোগদান করেন।