কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এক সপ্তাহেরও বেশি আগে অভিযোগ করেছিলেন যে, কানাডার মাটিতে খালিস্তান আন্দোলনের নেতা হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যাকাণ্ডে ভারত সরকার জড়িত। এ বিষয়ে তাঁর কাছে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ তথ্য আছে। এরপর থেকে ক্রমেই কানাডার সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে।
এই বিরোধের দৃশ্যপটে এরই মধ্যে হাজির হয়েছে দুই দেশেরই পুরোনো মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে ভারত আবার দক্ষিণ এশিয়ায় ওয়াশিংটনের সবচেয়ে বড় মিত্র। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিষয়টি বিড়ম্বনাকর হওয়ার কথা। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ায় তেমনটা মনে হচ্ছে না। তবে বাস্তবের চিত্র ভিন্নও হতে পারে। এমন অবস্থায় সবচেয়ে বড় যে প্রশ্ন উঠেছে, তা হলো, হরদীপ হত্যার ইস্যুতে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কে কার পরীক্ষা নিচ্ছে।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, অনেক ভারতীয়ই মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র হরদীপ ইস্যুতে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে সাহায্য করার বদলে অনেকটা এড়িয়ে চলছে। যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু এখনো এ ঘটনায় কানাডার পাশে থাকার বিষয়ে দৃঢ় অঙ্গীকার না করে, ভারতকে কোনো কড়া কথা না শুনিয়ে সহযোগিতা করার ‘নমনীয় আহ্বান জানিয়েছে, তাই এমনটা মনে করছেন তারা।
ইকোনমিস্টের ভাষ্য, যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থান সম্ভবত নরেন্দ্র মোদির সরকারে জন্য বিষয়টিকে দৃঢ়ভাবে উড়িয়ে দেওয়ার অবস্থান তৈরি করে দিয়েছে। উল্টো ভারত সরকার শুরু থেকেই কানাডার অভিযোগ ক্ষোভের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছে। অনেক ভারতীয় তাদের সরকারের এই অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছে। কারণ তাদের মতে, হরদীপ সিং নিজ্জার একজন ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ ও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। ভারতীয়রা পশ্চিমা বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দিতে চায় যে, এই খালিস্তানকে কেন্দ্র করে ১৯৭০-এর দশক থেকে ১৯৯০-এর দশকের শুরু পর্যন্ত যে পরিমাণ রক্তাক্ত ঘটনা ঘটেছে, তা পশ্চিমারা জানে না। শিখ দেহরক্ষীর হাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিহত হওয়ার ঘটনাও তারা পশ্চিমা বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দিতে চায়।
কিন্তু ভারত যতই দাবি উড়িয়ে দিক বা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুক না কেন, তাতে আসলে কানাডা একা হয়ে যাচ্ছে না। কারণ হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যাকাণ্ডের তদন্তে কানাডার কর্মকর্তারা সম্পৃক্ত যেসব ‘মানবীয় ও সাংকেতিক’ গোয়েন্দা যোগাযোগের আলামত সংগ্রহ করেছে, সেগুলো সরবরাহ করেছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের নিয়ে গঠিত জোট ‘ফাইভ আই’স ইন্টেলিজেন্স। এমনকি বিষয়টি নিয়ে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আলোচনাও করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বিষয়টি নিয়ে বাইডেন ছাড়াও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের নেতারাও মোদির সঙ্গে কথা বলেছেন। এ থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, জাস্টিন ট্রুডো কোনোভাবেই একা নয়। তবে এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে যে উষ্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছিল, তাতে খানিকটা শীতল জল ঢালা হয়েছে।
এখানেই শেষ নয়, যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টভাবে কানাডার পক্ষে কথা না বললেও দেশটি ভারতের পক্ষও নেয়নি। বরং আকারে ইঙ্গিতে কানাডার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেন, কানাডায় ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের খালিস্তান আন্দোলনের নেতা হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যাকাণ্ডের ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব নিরসনে উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এ বিষয়ে ভারতকে বিশেষ কোনো ছাড় যুক্তরাষ্ট্র দেবে না।
এই ইস্যুতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের বক্তব্যও উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ভারত ও কানাডা উভয় দেশের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখছে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা জবাবদিহি দেখতে চাই এবং তদন্তকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিতে এবং একটি ফলাফলে পৌঁছানোর জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ ভারত কানাডাকে তদন্তে সহযোগিতা করবে আশাবাদ ব্যক্ত করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আশা করি, আমাদের ভারতীয় বন্ধুরা এ ঘটনার তদন্তে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করবে।’ এ সময় তিনি ভারতের ওপর আনা কানাডার অভিযোগের সারবত্তার দিকে ইঙ্গিত না করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখছে।
ভারত সম্ভবত এখনো পশ্চিমা বিশ্বের ঐক্যের শক্তি উপলব্ধি করতে পারেনি। ভারত কানাডাকে একটি দ্বিতীয় সারির ক্ষমতাধর দেশ হিসেবে বিবেচনা করেছিল। তারা ভেবেছিল, অভিযোগগুলো যদি সত্য হয় তবে দেশটি হয়তো খুব কড়াভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে এবং মিথ্যা হলে বিষয়টি হয়তো এড়িয়ে যাবে। কিন্তু ঘটনা সত্য হোক বা মিথ্যা, কানাডা বিষয়টি থেকে পিছু হটেনি। ট্রুডো বারবার দৃঢ়ভাবে বলেছেন, তাদের কাছে উল্লেখযোগ্য প্রমাণ রয়েছে এবং যথাসময় তা প্রকাশও করা হবে।
এ বিষয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের ফেলো তানভি মদন বলেন, ‘ভারত যেভাবে বিষয়টিকে দেখছে, তা মূলত কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বন্ধনকে অস্বীকার করা। দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ ছাড়া এ ঘটনা আমেরিকার নিরাপত্তার জন্য একটি হুমকি। তারা (যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা) কোনোভাবেই চাইবে না উত্তর আমেরিকার মাটিতে কোনো বিদেশি হিটম্যান কাজ করুক। মূলত এ কারণেই আমেরিকায় শিখ সম্প্রদায়ের উপস্থিতি।’
তানভির বক্তব্যের সঙ্গে আমরা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেনের বক্তব্য মিলিয়ে পাঠ করতে পারি। ব্লিংকেন বলেছেন, ‘আমি মনে করি, এটি (হরদীপ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে কানাডাকে ভারতকে সহযোগিতা করা) আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার জন্য আরও ব্যাপকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ ঘটনা একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে যে কোনো দেশ এ ধরনের কাজে জড়িত থাকার ক্ষেত্রে আমলে নিয়ে ভবিষ্যতে সাবধান হয়ে যাবে।’ ব্লিংকেনের বক্তব্য থেকে এটি স্পষ্ট যে, ব্লিংকেন তথা যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টভাবে চায় ভারত এ ঘটনার তদন্তে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে কানাডাকে সহায়তা করুক। কারণ, এটি যুক্তরাষ্ট্রসহ উত্তর আমেরিকার নিরাপত্তার প্রশ্ন।
তবে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত যে একাই দোষী তা বোধ হয় না। ভারতের অভিযোগ, কানাডা দীর্ঘদিন ধরে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন পরিচালনা করার সুযোগ দিচ্ছে। নয়া দিল্লির দাবি, ভারতে বর্তমানে খুব বেশি শিখ ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ নেই। বরং পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তারা আশ্রয় নিয়ে তা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব এর ফলে যে, সহিংসতার পুনরুদ্ভব হতে পারে সে বিষয়টিকে খুব বেশি আমলে নিচ্ছে না। এমনকি ১৯৮৫ সালে কানাডার মন্ট্রিল থেকে লন্ডনগামী এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইট বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার পরও পশ্চিমা বিশ্ব বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায়নি। তবে এসব ঘটনা বা বিষয়ের আলোকে যদি ভারত মনে করে থাকে যে, এসব ঘটনা কানাডার মাটিতে গুপ্তহত্যা ঘটানোকে বৈধতা দেবে তবে তা হবে খুবই শিশুসুলভ ভাবনা।
ভারতের অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে, তারা নিজ্জারের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি বেমালুম অস্বীকার করবে, এমনকি পর্যাপ্ত প্রমাণাদি যদি জনসমক্ষে আনা হয় তারপরও। ভারত যদি এমনটা করে তাহলে যে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র তার কৌশলগত সম্পর্ক ছিন্ন করবে এমনটাও মনে হচ্ছে না এবং সম্ভবত এই অবস্থান যৌক্তিকও বটে। সে ক্ষেত্রে এই ঘটনা ভারতের প্রতিরক্ষা খাতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে যে দ্বিপক্ষীয় অংশীদারত্ব, দুই দেশের সাধারণ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ—তার ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। কারণ, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক মূলত চীনকে কেন্দ্র করে উভয় দেশের সাধারণ স্বার্থকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এবং ঠিক এ কারণেই হয়তো মোদি এবং তাঁর দল বিজেপি ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষতের সৃষ্টি করলেও বাইডেন প্রশাসন তা নিয়ে খুব বেশি সমালোচনা কখনোই করেনি।