সর্বজনীন পেনশন স্কিমের চাঁদার বিপরীতে কর রেয়াত বা ছাড় পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মূলত আয়কর আইনের ষষ্ঠ তফশিলে (কর অব্যাহতি, রেয়াত ও ক্রেডিট) পেনশন স্কিমের চাঁদার কথা উল্লেখ না থাকায় এ নিয়ে আয়কর আইনজীবী এবং করদাতাদের মাঝে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে শিগগিরই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন ২০২৩-এর ১৪(১)(ঢ) ধারায় বলা আছে, পেনশনের চাঁদা বিনিয়োগ হিসাবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে।
যদিও আয়কর আইন ২০২৩-এর ৭৬(২) ধারায় বলা আছে, আয়কর আইন ব্যতীত অন্য কোনো আইন বা আইন হিসাবে পরিগণিত দলিলের মাধ্যমে যদি কোনো ব্যক্তিকে কর অব্যাহতি দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে ওই আইন বা আইন হিসাবে পরিগণিত দলিলে যাই থাকুক না কেন, এনবিআর প্রজ্ঞাপন দ্বারা ওই ব্যক্তিকে কর অব্যাহতি না দিলে সেই বিধান কার্যকর হবে না।
আয়কর আইনের ষষ্ঠ তফশিলে (অংশ-৩) বলা হয়েছে, জীবনবিমার প্রিমিয়াম, প্রভিডেন্ট ফান্ডের চাঁদা, স্বীকৃত ভবিষ্যতহবিলের চাঁদা, সরকারি সিকিউরিটিজ বা মিউচ্যুয়াল ফান্ডে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ, বছরে ১ লাখ ২০ টাকা (মাসিক ১০ হাজার) ডিপিএসে বিনিয়োগ, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করলে সেই অর্থের ওপর কর রেয়াত বা করছাড় পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে উল্লিখিত খাতে যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা হবে, তার ১৫ শতাংশ বা ১০ লাখ টাকার কম যেই অর্থ, সেই পরিমাণ অর্থ করছাড় পাওয়া যাবে। ষষ্ঠ তফশিলে পেনশন স্কিমের চাঁদার কথা উল্লেখ নেই।
১৭ আগস্ট সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক মাসে পেনশন নিবন্ধন চূড়ান্ত করেন ১২ হাজার ৮৯২ জন। সবচেয়ে বেশি নিবন্ধন করেছেন ‘প্রগতি’ স্কিমে। এখানে বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। এ স্কিমে মোট অর্থ জমা পড়েছে ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ‘সুরক্ষা’ স্কিম। এখানে নিবন্ধন করেছেন ৪ হাজার ৯৬৪ জন। বিপরীতে অর্থ জমা পড়েছে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৯ হাজার টাকা। নিবন্ধনের ক্ষেত্রে তৃতীয় অবস্থানে আছে ‘সমতা’ স্কিম। এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩২১ জন বিবন্ধন করেছেন। বিপরীতে অর্থ জমা পড়েছে ২১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। তবে সবচেয়ে কম সাড়া পড়েছে ‘প্রবাসী’ স্কিমে। এখানে এখন পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন ৩৯৩ জন। বিপরীতে অর্থ জমা পড়েছে ৮১ লাখ ২৭ হাজার ৫০০ টাকা।
এ বিষয়ে ঢাকা ট্যাকসেস বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সুফী মোহাম্মদ আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, নতুন আয়কর আইনে বিনিয়োগজনিত কর রেয়াতে খাতের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে। সেই তালিকায় সর্বজনীন পেনশনের কথা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ নেই। তাই পেনশনের চাঁদার বিপরীতে কর রেয়াত দাবি করলে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা তা বাতিল করে দিতে পারেন। পেনশন যেহেতু বর্তমান সরকারের মহৎ একটি উদ্যোগ, তাই এনবিআর পেনশনের চাঁদাকে ষষ্ঠ তফশিলে অন্তর্ভুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করলে জটিলতা থাকবে না। তা না হলে ভবিষ্যতে জনমনে পেনশন নিয়ে নেতিবাচক ধারণাও তৈরি হতে পারে। আইনি ব্যাখ্যা সম্পর্কে জানতে এনবিআর-এর আয়কর নীতির সদস্য শামস উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক আয়কর কর্মকর্তা বলেন, সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান নিজেদের আইনে কর অব্যাহতি দিচ্ছে, যার আইনগত ভিত্তি নেই। কেবল আয়কর আইন অনুযায়ী আয়কর অব্যাহতি দেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে এনবিআর-এর। এ বিষয়ে নিজেরা নিজেদের কর অব্যাহতি দিয়ে কোনো আদেশ, প্রজ্ঞাপন বা এসআরও জারি করলেও আয়কর আইনে এর বৈধতা নেই। আয়কর আইনের যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে রিটার্ন জমা থেকে অব্যাহতি বা বিনিয়োগজনিত কর রেয়াত দেওয়া হয়েছে, কেবল সেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান করছাড় পাবে।
অন্যদিকে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি আমরা অবগত আছি। আইনে যেহেতু পেনশনের চাঁদায় বিনিয়োগকে কর রেয়াতযোগ্য বলা আছে, সেহেতু বিনিয়োগকারীরা চাঁদার বিপরীতে কর রেয়াত পাবেন। আয়কর আইনে কোনো কারণে বিষয়টি বাদ যেতে পারে। তবে এনবিআর প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে পেনশনকে কর রেয়াতযোগ্য বিনিয়োগের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
অতীতের দুটি ঘটনা : বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ও পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের (পিডিবিএফ) রিটার্ন জমা ও আয়কর আইন প্রতিপালন নিয়ে এনবিআর-এর সঙ্গে সংস্থা দুটির টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। সংস্থা দুটি নিজেদের আইনে নিজেদের আয়কর অব্যাহতি দিচ্ছে।
টেলিকমিউনিকেশন আইন ২০০১-এর ২৫ ধারায় বলা আছে, অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যা কিছুই থাকুক না কেন, কমিশন তার কোনো সম্পদ ধারণ বা আয় বা প্রাপ্তির জন্য কোনো প্রকার আয়কর প্রদানের জন্য দায়ী হবে না এবং ওই কর প্রদান থেকে কমিশনকে এতদ্দারা অব্যাহতি প্রদান করা হলো।
অন্যদিকে পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন আইন ১৯৯৯-এর ২৭ ধারায় বলা আছ, আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ অথবা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে কর, অধিকর বা ব্যবসায় মুনাফা কর সম্পর্কে যা থাকুক, সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা যেরূপ মেয়াদ নির্ধারণ করে, সেরূপ মেয়াদের জন্য ফাউন্ডেশনকে কোনো আয়, মুনাফা বা প্রাপ্তির ওপর অনুরূপ কোনো কর প্রদান করতে হবে না।
সম্প্রতি অডিট অধিদপ্তর উৎসে কর কর্তন না করায় পিডিবিএফ-এর ২০১৪-১৫ অর্থবছরের কেনাকাটায় অডিট আপত্তি দেয়। অডিট আপত্তির বিষয়টি সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভায় উপস্থাপন করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্থায়ী কমিটি পিডিবিএফ-এর কর অব্যাহতির বিষয়ে মতামত চেয়ে এনবিআর-এ চিঠি দেয়। ২৪ জুলাই এনবিআর-এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, “দ্য জেনারেল ক্লজ অ্যাক্ট, ১৮৯৭-এর ধারা ৩, উপধারা ৯এ অনুযায়ী ‘চিফ রেভিনিউ অথরিটি’ বলতে এনবিআরকে অভিহিত করায় কর রাজস্বসংক্রান্ত সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র ক্ষমতা এনবিআর-এর হাতে ন্যস্ত।” রুলস অব বিজনেস, ১৯৯৬ অনুযায়ী, করারোপ ও কর অব্যাহতি প্রদানের বিষয়টি সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের এখতিয়ারভুক্ত। সে অনুসারে আয়করসংক্রান্ত এসআরও জারি করার এখতিয়ার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নেই। এছাড়া আয়কর আইন, ২০২৩-এর ৭৬ ধারা অনুযায়ী, পিডিবিএফ-এর আইনে যে কর অব্যাহতি প্রদান করা হোক না কেন এনবিআর এই বিষয়ের প্রজ্ঞাপন দ্বারা কর অব্যাহতি প্রদান না করলে এই বিধান কার্যকর হবে না। ফলে সমবায় বিভাগ কর্তৃক প্রজ্ঞাপন দ্বারা কর অব্যাহতির আইনানুগ কার্যকারিতা নেই।