২৪ নভেম্বর ২০২৪, রবিবার, ০৭:১৬:০১ অপরাহ্ন
নীতির ভুলে আরও ঝুঁকিতে রিজার্ভ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-১০-২০২৩
নীতির ভুলে আরও ঝুঁকিতে রিজার্ভ

রপ্তানি আয়ে খরা চলছে। রেমিট্যান্সেও একই হাল। দেশে ডলার আসার প্রধান এই দুটি পথ সংকীর্ণ হওয়ায় টান পড়েছে রিজার্ভে। এই পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর উচিত ছিল প্রবাসী কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়িয়ে রিজার্ভকে সমৃদ্ধ করা। কিন্তু তা না করে উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সহজে ডলার কেনার জন্য বসে থাকছে তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ডলার সরবরাহ করে যাচ্ছে তাদের। এতে ঝুঁকি বাড়ছে রিজার্ভে।


বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত বলছে, গত তিন মাসে রিজার্ভ থেকে প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ গতকালও বিক্রি করেছে ৮০ মিলিয়ন ডলার। ফলে আইএমএফের হিসাবে রিজার্ভ ২১ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলারে ঠেকেছে। সবকিছু যেভাবে চলছে, তাতে ডলারের সংকট শিগগির কাটার কোনো লক্ষণ দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা।


এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘রিজার্ভ কমছে, তবু ডলার বিক্রি করার মানে হয় না।এসব বন্ধ করতে হবে। হুন্ডি বন্ধে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে বৈধ পথে রিজার্ভ বাড়াতে হবে। এসব অল্প সময়ে হবে না। অন্তত কয়েক মাস লাগবে। তার মানে রিজার্ভ খরচ কমাতে না পারলে সামনে ঘাটতি বাড়বে।’


দেশে ডলারের বড় জোগান আসে প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, সদ্য বিদায়ী সেপ্টেম্বরে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছে ১ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার, যা গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ১ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। সেই হিসাবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছরের সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ।


সংকটের এই রেমিট্যান্স প্রবাহ এভাবে কমার পেছনে কয়েকটি কারণকে দায়ী করেছেন বিশ্লেষকেরা। সবচেয়ে বড় কারণটি হলো ব্যাংকিং চ্যানেল ও  হুন্ডির মধ্যে ডলারের দামের বড় ব্যবধান। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালে প্রবাসীরা পান ১০৯ টাকা। আর হুন্ডিতে পাঠালে কোনো খরচ ছাড়া, বাকিতে পরিশোধ করেও খুব সহজে, কম সময়ে প্রতি ডলারের বিপরীতে তাঁরা পান ৯-১০ টাকা বেশি।


এ ছাড়া সামনে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে কিছুটা অনিশ্চয়তাও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমার অন্যতম  কারণ। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ডলারের আগাম দরের (বুকিং রেট) ঘোষণা দিয়েছে। এটিও রেমিট্যান্স কমার আরেকটি কারণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। তাঁদের ধারণা, বুকিং রেটের এই ঘোষণায় প্রবাসীরা পরে লাভ পাওয়ার আশায় ডলার ছাড়ে আরও বেশি রক্ষণশীল হবেন। এটা হলে সামনে রেমিট্যান্স প্রবাহে আরও ধাক্কা লাগতে পারে বলে আশঙ্কা তাঁদের।


২০২৩ সালের পুরো সময় ডলার-সংকট থাকবে—চলতি বছরের শুরুতেই এমন আভাস দিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। ডলারের গতি-প্রকৃতি এবং রিজার্ভ পরিস্থিতি এখন সেই বার্তাই দিচ্ছে। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বর্তমানে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স ভালো অবস্থানে নেই। নির্বাচনের আগপর্যন্ত চাল, ডাল, তেল ইত্যাদি আমদানি করতেই হবে।


এতে রিজার্ভের আরও ঘাটতি সৃষ্টি হবে। তবে নির্বাচনের আগে রিজার্ভ বাড়ানোর তেমন কোনো উপায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের থাকছে না বলে গভর্নর স্বীকার করেছেন, যা গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। এ জন্য নির্বাচনের পর সরকারের নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক সুদহার ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার আরও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ডলারে আয় বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন উৎস খুঁজে বের করতে হবে। তা না হলে রিজার্ভে যে আরও পতন অপেক্ষা করছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’


চলমান ডলার-সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে  ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে ঋণের প্রথম কিস্তি এসেছে। কিন্তু শর্ত পূরণ না হওয়ায় আইএমএফ দ্বিতীয় কিস্তি এখনই ছাড় করবে কি না তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে। শর্তের দোহাই দিয়ে আইএমএফ যদি নভেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় না করে, তাহলে রিজার্ভ পরিস্থিতি আরও নাজুক হতে পারে।


সংকটের এই সময়ে ডলার সাশ্রয়ে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। একসময় প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি আমদানি বিল পরিশোধ করা হতো। পরে তা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। গত জুনে প্রায় সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল নিষ্পত্তি করা হয়। তবু রিজার্ভ কমছে। জুলাই থেকে আবার আমদানি ব্যয় বাড়তে থাকে। ওই মাসে বিল নিষ্পত্তি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরেও তা প্রায় সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরেই রয়েছে। এভাবে বাড়তে থাকলে সামনে রিজার্ভে চাপ আরও তৈরি করবে।


শেয়ার করুন