পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১৭ হাজার ৫৬৮ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বিদেশি ক্রেতারা প্রতি পিস পোশাকের দাম ৭ সেন্ট বা ৭৭ টাকা (এক ডলার ১১০ টাকা হিসাবে) বাড়ালে শ্রমিকদের মজুরি দিতে মালিকদের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে না। তবে শ্রমিক সংগঠনের নেতারা বলছেন, বর্তমান বাজার দরের প্রেক্ষাপটে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কমপক্ষে ২৩ হাজার টাকা হওয়া উচিত।
রোববার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ‘গার্মেন্ট খাতে ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ : পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাবনা’ শীর্ষক সংলাপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সিপিডি ও ক্রিশ্চিয়ানএইড আয়োজিত এ সংলাপে সম্মানিত অতিথি ছিলেন ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লা। এ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান, বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি অ্যাডভোকেট মন্টু ঘোষ।
সংলাপে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ২২৮ জন শ্রমিক ও ৭৬ কারখানায় জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে-অনেক কারখানায় শ্রমিকরা ২০১৮ সালে ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি পান না। এমনকি শ্রমিকরা কোন গ্রেডে কাজ করছেন তারা তাও জানেন না। পদোন্নতি পেতে ঊর্ধ্বতন গ্রেডে যেতে কতদিন সময় লাগে তাও জানেন না। বেতন না পেলে কোথায় অভিযোগ জানাতে হবে সেটাও তারা জানেন না। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদপ্তরের (ডাইফ) উচিত ছিল, গুরুত্ব দিয়ে মজুরি কাঠামোর বাস্তবায়ন তদারকি করা।
এতে আরও বলা হয়, গার্মেন্টস মালিকরা ন্যূনতম ১২ হাজার টাকা মজুরি হিসাবে দিতে চান, আর শ্রমিকরা চান ১৮ হাজার টাকা। জীবনযাত্রার ব্যয় ও মূল্যস্ফীতি হিসাবে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১৭ হাজার ৫৬৮ টাকা হওয়া উচিত। বায়াররা প্রতি পিস পোশাকের দাম ৭ সেন্ট বাড়ালে মালিকদের বাড়তি মজুরি দিতে চাপে পড়তে হবে না। নতুন মজুরি কাঠামোতে অন্য ভাতা কোনোরকম ভাবে না বাড়িয়ে মূল বেতনের সঙ্গে আনুপাতিক হারে বাড়ানো যেতে পারে। মালিক, শ্রমিক ও ডাইফ বা শ্রম মন্ত্রণালয়-ত্রিপক্ষীয় কমিটি গঠনের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে মজুরি বাস্তবায়ন কার্যক্রম তদারকি করতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সভাপতি ও মজুরি বোর্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, শ্রমঘন অঞ্চলে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ভাড়া বাড়ানো হয়, এতে শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির সুফল পান না। তাই বাড়ি ভাড়া বাড়ানো বন্ধে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনকে কাজ করতে হবে।
বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও মজুরি বোর্ডের সদস্য সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শ্রমিকরা পোশাক শিল্প পরিবারের অংশ। মালিকরা ২৩-২৫ হাজার টাকা মজুরি দিতে চান। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আদৌ তাদের সামর্থ্য আছে কিনা বা সম্ভব কিনা। মজুরি বোর্ডের এমনভাবে মজুরি বাড়ানো উচিত, যাতে কারখানা বন্ধ না হয়ে যায়।
গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি অ্যাডভোকেট মন্টু ঘোষ বলেন, পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা এবং বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ১০ শতাংশ হওয়া উচিত। বাস্তব সংকট বিবেচনায় নিয়ে মজুরি নির্ধারণ করা হলে পোশাক খাত আরও এগিয়ে যাবে।
বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিদেশি ক্রেতাদের বায়িং বা সোর্সিং টিম এবং কমপ্লায়েন্স বা ইথিক্যাল টিমের মধ্যে সমন্বয় নেই। বায়িং টিম কম দামে পণ্য চায়, আর ইথিক্যাল টিম বলে ইথিকস (নৈতিকতা) মেনে পণ্য বানাও। এ ক্ষেত্রে বায়িং টিম ইথিক্যালি এ কাজ করছে কিনা, সেটা বায়ারদের ইথিক্যাল টিম দেখে না। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বায়ার এবং ব্রান্ডরা বাংলাদেশের শিল্প ও শ্রমিকদের রক্ত চুষছে বর্তমানে।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, সবাই বেতন নিয়ে আলোচনা করছে। কিন্তু বেতনের পাশাপাশি শ্রমিকরা অন্য যে সুবিধা পাচ্ছে, সে বিষয়ে কেউ বলছে না। এখন মাতৃত্বকালীন সুবিধা, ছুটি ভাতাসহ শ্রমিকরা আনুষঙ্গিক সুবিধা পাচ্ছেন, সে বিষয়েও আলোচনা হওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় মালিকরাও চায় শ্রমিকের মজুরি বাড়ুক। কিন্তু মালিকদেরও তা দেওয়ার সক্ষমতা থাকতে হবে। এই মুহূর্তে অর্ডার কমে গেছে, কর্মসংস্থান ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ছে। পোশাকের দাম বাড়াতে বিজিএমইএ বিদেশি ক্রেতাদের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিচ্ছে।
মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লা বলেন, গঠনের পর এখন পর্যন্ত ৩টি বৈঠক করেছে মজুরি বোর্ড। এ মাসের শেষের দিকে আরেকটি বৈঠক হবে, যেখানে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো মজুরির ব্যাপারে প্রস্তাব দেবে। নভেম্বরের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য মজুরি কাঠামো ঘোষণা করতে পারব বলে আশা করছি।