২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৮:০৭:১২ অপরাহ্ন
সাপুড়ে থেকে সাপ গবেষক! বন্ধুর পথ মাড়িয়ে নতুন দিগন্তে সাপ রক্ষার আন্দোলন
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-১০-২০২৩
সাপুড়ে থেকে সাপ গবেষক! বন্ধুর পথ মাড়িয়ে নতুন দিগন্তে সাপ রক্ষার আন্দোলন

সাপ যে মানুষের জন্য উপকারী বন্ধু, এটা এখনো অধিকাংশ মানুষের কাছে অবিশ্বাস্য। বিশেষ করে প্রান্তিক এলাকাগুলোতে সাপ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনার গল্প-কাহিনী প্রচলিত আছে। একই সঙ্গে সাপ ভীতিও রয়েছে চরম মাত্রায়। সাপ দেখে আতঙ্ক হয়ে হত্যার রীতিও আছে। আর এই নিরীহ প্রাণী সাপকে কেন্দ্র করে ওঝা ও কবিরাজি ব্যবসাও জমজমাট। এই যখন বাস্তবতা তখন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণার মাধ্যমে দেশে সাপ রক্ষায় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন রাজশাহীর কৃতী সন্তান প্রকৃতিপ্রেমি বোরহান বিশ্বাস ওরফে রুমন। স্থানীয়দের কাছে তিনি ‘সাপুড়ে’ হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি একজন গবেষক। তার গবেষণা আর্ন্তজাতিক অঙ্গনেও সমাদৃত হচ্ছে।


বোরহান বিশ্বাসের বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার আফিনেপালপাড়া গ্রামে। অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপনকারী এই যুবক দেশের ‘সাপ রক্ষার সামাজিক আন্দোলনে রোল মডেল’ হিসেবেও পরিচিতি পাচ্ছেন। তবে তার সাপ প্রীতি এবং মানুষের সঙ্গে সাপের সহাবস্থানের আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকেই কন্টকাকীর্ণ। তবে গবেষণালব্ধ জ্ঞান সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে সম্ভাবনার নতুন দিগন্তও উন্মোচিত হয়েছে। শুধু রাজশাহী নয়, দেশের হাজারো প্রকৃতিপ্রেমিরা বোরহানের সাপ রক্ষার সামাজিক আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন।বোরহানের সাপপ্রীতি একটা সময় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধিদপ্তরও মনে করতো ঝুঁকিপূর্ণ।


একারণে সাপ পোষার অপরাধে ছয়মাসের সাজাও দিয়েছিলো এ দফতর। তবে সময়ের সঙ্গে তাদের ভেঙ্গেছে ভুল। এখন ওই দফতরেরই প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন বোরহান বিশ্বাস। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের প্রশিক্ষক। এশিয়ার মধ্যে প্রথম ব্যক্তিউদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্নেক রেসকিউ অ্যান্ড কনজারভেশন সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।


এ পর্যন্ত আন্তজার্তিক পর্যায়ে তার সাপ নিয়ে ৭ টি গবেষণা প্রকাশ পেয়েছে। সাপ নিয়ে বাংলা ভাষায় গবেষণাধর্মী বইও লিখছেন তিনি। এছাড়া সামরিক বাহিনীর আমন্ত্রিত প্রশিক্ষক হিসেবেও সাপ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন এই প্রকৃতিপ্রেমি।


সাপের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ বোরহান বিশ্বাস। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক প্রতিবন্ধকতাগুলোকে এখন সম্ভাবনায় রূপান্তর করেছেন তিনি। সাপ ও মানুষের সহাবস্থানে বন্ধুর পথ মাড়িয়ে নতুন এক দিগন্তের দিকে ধাবিত হচ্ছেন এই প্রকৃতিপ্রেমি।


বোরহান বিশ্বাস বলেন, সাপের প্রতি ভালোবাসা মূলত তৈরি হয়েছে প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে। একটা সময় আমিও সাপকে ভয় পেতাম। কিন্তু সাপ আমাদের সকল দিক দিয়ে উপকারী বন্ধু। মানুষ যদি এই উপকারগুলোকে উপলদ্ধি করতো, তাহলে সাপ বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হতো না। মানুষ এখনো ইচ্ছেমতো সাপ দেখলেই হত্যা করে। তিনি আরও বলেন, স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ জীবনের শুরুতে যখন বুঝলাম, প্রকৃতির সুরক্ষায় সাপের কোনো বিকল্প নেই- অথচ মানুষ সাপকে ইচ্ছেমতো হত্যা করছে, তখনই সাপ রক্ষাসহ সাপের কামড়ে যেন কেউ না মারা যায় এ বিষয়ে কিছু করার বাসনা জাগে। এরপর সাপ সংরক্ষণে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করি। মানুষের মাঝে সাপ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করতে থাকি।


প্রথমদিকে যখন আমি সাপ ধরতে যেতাম, তখন আমি জানতাম; যদি দংশিত হয়, তাহলে মৃত্যু ছাড়া উপায় নেয়। কারণ দেশে তখনো সাপে কাটা রোগীদের এন্টিভেনাম তেমনভাবে আসে নি। প্রথম দিকে পরিবার বাঁধা দেয়। সমাজের মানুষ বাঁধা দেয়। সাজা পর্যন্ত হয়েছে। তবে মজার বিষয় হলো, সে সময় ৬ মাসের কারাদণ্ড দিয়ে জব্দ করা সাপগুলো আমার জিম্মাতেই রাখা হয়েছিলো। সে সময় ভুলবুঝেই সাজাটা দেয়া হয়েছিলো। এখন বন বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে, তাদের একজন হয়েই কাজ করছি।


বোরহান বিশ্বাস আরও বলেন, সর্প দংশনের পর এখনো দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ হাসপাতালে না গিয়ে ওঝার কাছে যায়। এটা খুবই এলার্মিং। এ অবস্থার উত্তরণে সামাজিক আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। এই আন্দোলনে বর্তমানে সারাদেশের অনেক যুবক স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন। এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাপ ধরার জন্য ফোন আসে। ঘটনাস্থলে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবীদের সহযোগিতায় বিষাক্ত সাপ উদ্ধার করছি। উদ্ধারকৃত সাপ আমার স্নেক রেসকিউ অ্যান্ড কনজারভেশন সেন্টারে রাখা হচ্ছে।


তিনি জানান, ২০১২ সালের আগে সাপকে বণ্যপ্রাণী হিসেবেই ধরা হতো না। সে সময় উদ্ধারকৃত সাপ বণ্যপ্রাণী দফতর বনেও ছাড়তে পারতেন না; আবার সংরক্ষণেও তাদের কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। সে সময় উদ্ধরকৃত সাপ স্নেক রেসকিউ অ্যান্ড কনজারভেশন সেন্টারে পাঠানো হতো। এই সেন্টারটি এশিয়ার মধ্যে প্রথম ব্যক্তি উদ্যোগে গঠিত। সাপ রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রকৃতিতে সাপ ও মানুষের সহাবস্থান অত্যন্ত জরুরি। সাপ ক্ষতিকর প্রাণী না। সাপ কখনোয় নিজে থেকে ক্ষতি করতে চায় না। সে চায় না, তার মহামূল্যবান বিষ মানুষের উপর নিক্ষেপ করে নিজের ক্ষতি করতে। দুর্ঘটাবশত আতঙ্কিত হয়ে সাপ মানুষকে দংশন করে। মানুষ একটু সতর্ক ও সাপের প্রতি সদয় হলেই সর্প দংশন ও সর্প হত্যা কমে আসবে। আর আমার স্বপ্ন তখনই পূরণ হবে, যখন দেশে সর্প দংশনে কেউ মারা যাবে না এবং একটি সাপও হত্যার শিকার হবে না।


শেয়ার করুন