১৪ অক্টোবর ২০২৫, মঙ্গলবার, ০৬:৫০:২৩ অপরাহ্ন
অতিরিক্ত রেগে যাওয়া অনুভূতির প্রকাশ নাকি একটি রোগ?
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-১০-২০২৫
অতিরিক্ত রেগে যাওয়া অনুভূতির প্রকাশ নাকি একটি রোগ?

আপনি এমন কাউকে কখনো দেখেছেন কি- যিনি এমন একটি বিষয়ে খুব দ্রুত রাগে- ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন, কিন্তু ওই বিষয়টিতে হয়তো ততটা উত্তেজনা বা প্রতিক্রিয়া দেখানোর কোনো প্রয়োজন আসলে ছিল না? ওই সময় আপনি কি ওই রাগান্বিত ব্যক্তির চেহারা কখনো খেয়াল করেছেন?


এ সময় তার মুখ ঘামতে শুরু করে এবং সে সহিংস বা হিংসাত্মক শব্দ ব্যবহার বা অস্পষ্টভাবে এসব শব্দ উচ্চারণ করতেও শোনা যায়। অথবা আপনি কি ওই একই ব্যক্তিকে তার রাগ বা ক্রোধের পর শান্ত, সংযত এবং তার ওই আচরণের জন্য অনুতপ্ত হতে দেখেছেন? 


আপনি হয়তো ওই ব্যক্তিদের এমন কথা বলে ন্যায্যতা দিতে শুনবেন যে তারা বলছে, এই রাগ তাদের ব্যক্তিত্ব বা চরিত্রের অংশ। অথবা এই রাগ মানুষ হিসেবে আমাদের অনুভূতিরই একটা অংশ। 


যদিও চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই দ্রুত ও তীব্র রাগের বহিঃপ্রকাশকে একটি রোগ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এটি 'ইন্টারমিটেন্ট এক্সপ্লোসিভ ডিসঅর্ডার' রোগ নামে পরিচিত।


আমরা মাঝে মাঝে এমন কথা বলি যে, 'সে রেগে গেছে' বা 'রাগে ফেটে পড়েছে'– এমন সব রাগ বা ক্রোধের আচরণের ক্ষেত্রে এই রোগ 'ইন্টারমিটেন্ট এক্সপ্লোসিভ ডিসঅর্ডার' প্রযোজ্য হতে পারে।


কিন্তু সব ধরনের রাগই কি এই এক্সপ্লোসিভ ডিসঅর্ডার বোঝায়?


নাকি রাগ একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া এবং আমাদের অনুভূতি প্রকাশের জন্য মানব প্রকৃতি ও মানুষের আচরণের একটি অংশ হতে পারে? 


রাগের এই 'ইন্টারমিটেন্ট এক্সপ্লোসিভ ডিসঅর্ডার' রোগ নির্ণয়ের প্রথম মানদণ্ড বা বৈশিষ্ট্য হলো পরিস্থিতির প্রতি অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া। এর অর্থ দাঁড়ায় তীব্র রাগ হলো এমন একটি প্রতিক্রিয়া যখন কোনো পরিস্থিতির জন্য এমন উত্তেজনা বা ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ করা, যতটা করার আসলে কোনো প্রয়োজন নেই।


অনেকেই আছেন এমন ভয়ঙ্কর রেগে যান যে অন্যদের প্রতি সহিংস বা হিংসাত্মক আচরণ করেন। কিন্তু ওই ঘটনার সময় তাদের মেজাজ যে খারাপ ছিল বিষয়টি কিন্তু এমন নয়।


লেবানিজ আমেরিকান ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের মনোরোগ বিভাগের প্রধান জোসেলিন আজার বলেন, এই এক্সপ্লোসিভ অ্যাঙ্গার ডিসঅর্ডার বা বিস্ফোরক রাগ ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন। এমন ব্যক্তিরা তীব্রভাবে রেগে যাওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সারাদিনই স্বাভাবিক আচরণ করেন। 


আগে এটা শুনিনি কেন আমরা? 


সায়েন্স ডাইরেক্ট সর্বশেষ যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ১৭টি পৃথক দেশের ২৯টি গবেষণায় পাওয়া গেছে– এই ইন্টারমিটেন্ট এক্সপ্লোসিভ ডিসঅর্ডারে পাঁচ দশমিক এক শতাংশ মানুষ আজীবনের জন্য আক্রান্ত হন।


এক লাখ ৮২ হাজার ১১২ জন মানুষের ওপর এই গবেষণা করা হয়েছে। এই ইন্টারমিটেন্ট এক্সপ্লোসিভ ডিসঅর্ডার হলো মানসিক স্বাস্থ্যের একটি অবস্থা।


এ ধরনের অবস্থায় হঠাৎ, অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং আগ্রাসনমূলক আচরণের একটি আক্রমণাত্মক বিস্ফোরণ ঘটে। এ ধরনের আচরণ ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অফ মেন্টাল ডিসঅর্ডারস এ তালিকাভুক্ত।


আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের মতে, এমন কিছু ফ্যাক্টর বা কারণ রয়েছে, যেটি রোগ নির্ণয়ের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। সেই সাথে এটি অন্যান্য চিকিৎসার সাথে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে।


যেমন: বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার, বাইপোলার ডিসঅর্ডার এবং কখনো কখনো মনোযোগ ঘাটতিজনিত হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার বা এডিএইচডির সাথে বিভ্রান্তি তৈরি করে এই অতিরিক্ত রাগজনিত রোগের লক্ষণগুলো।


আবার আরেকটি সহজ কারণ হলো, অনেকেই এরকম রাগের প্রবণতা (অ্যাঙ্গার অ্যাটাক) বা লক্ষণ দেখা দিলেও চিকিৎসক বা মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ নেন না। 


লেবানিজ আমেরিকান ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের প্রধান জোসেলিন আজার ব্যাখ্যা করে বলেন, যদিও অন্যান্য হেলথ কন্ডিশন বা স্বাস্থ্যগত অবস্থার সাথে এই রোগটি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে।


এই এক্সপ্লোসিভ ডিসঅর্ডার মাঝে মাঝে হতে পারে এবং 'চরিত্র বা ব্যক্তিত্বের অংশ' হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।


উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, যখন এমন একটি পরিস্থিতি দেখা দেয় যেটি কোনো ব্যক্তির মধ্যে একটি তীব্র, অযৌক্তিক মানসিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং তারপর তারা খুব দ্রুত শান্ত হয়ে যায়। এরকম পরিস্থিতিতে ওই ব্যক্তি নার্ভাস বলে উল্লেখ করা হয়। এটি বিবেচনা করা হয় না যে, তাদের আচরণ তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করতে পারে।


আজার আরো বলেন, যদি আপনি দীর্ঘদিন ধরে ওই ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ না রাখেন, তাহলে কোনো সমস্যা আছে এ বিষয়টি আপনি লক্ষ্য করবেন না। আপনি হয়তো ধারণা করবেন যে ওই ব্যক্তির রাগ হঠাৎ করেই অথবা আপনার অজানা কোনো কারণে হয়েছে। 


নার্ভাস প্রকৃতির কোনো ব্যক্তি কি আছেন?


আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের মতে, বিজ্ঞানের ভাষায় রাগকে একটি নেতিবাচক অনুভূতি বা আবেগ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই অ্যাসোসিয়েশনের মতে, হতাশা, আঘাত কিংবা কারো দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতির ফলে এই উত্তেজনা বা শত্রুতাপূর্ণ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে।


বাস্তবে হোক বা কল্পনায় হোক এই নেতিবাচক রাগ অন্যায় বা হুমকির অনুভূতির ফলেও তৈরি হয়।


একাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার ওপর ভিত্তি করে দ্য গার্ডিয়ান ২০১৯ সালে 'দ্য সায়েন্স অব অ্যাঙ্গার' শিরোনামে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করে।


এই আর্টিকেলে উল্লেখ করা হয়েছে, বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, লাখ লাখ বছরের বিবর্তনের ফলে রাগের ক্ষমতা মস্তিষ্কে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে আছে। এটি সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতা করা, যে কোনো হুমকির মুখোমুখি হওয়া এবং মানুষের সামাজিক আচার-আচরণ প্রয়োগের প্রবৃত্তিরই একটি অংশ।


এতে আরও বলা হয়েছে, এই রাগের ভিত্তিমূল মানুষের মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সার্কিট্রির একেবারে গভীরে। মস্তিষ্কের এই রিওয়ার্ড বা পুরস্কার সার্কিট স্নায়বিক নেটওয়ার্ক দিয়ে গঠিত এমন একটি অঞ্চল যা মানুষের আনন্দের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং আচরণকে প্রভাবিত করে।


আজার বলেন, আসলে এই রাগ কখনো কখনো কেবল স্বাভাবিক রাগ নয় বরং পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার বা ব্যক্তিত্বের ব্যাধির একটি অংশ।


মাঝে মাঝেই ঘটে এমন এই এক্সপ্লোসিভ ডিসঅর্ডার সম্পর্কে আজার বলেন, আমরা সাধারণত পরিস্থিতির প্রতি অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়ার কথা বলি, যেটির অর্থ হলো এই কারণগুলো সাধারণত এই প্রতিক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করে না।


আজার আরো বলেন, কিন্তু লেবাননের মতো দেশের ক্ষেত্রে যেখানে বেশিরভাগ মানুষই এই চাপ সহ্য করতে পারেন না। তারা উদ্বিগ্ন হন এবং তারা এমনকি হতাশায়ও ভোগেন। এরকম ক্ষেত্রে তাদের ডিসঅর্ডার বা ব্যাধি নয় বরং অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াই কারণ হতে পারে।


তাই আজারের মতে, কোন পরিস্থিতিতে একজন ব্যক্তির রাগের উদ্রেক হয় সেটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া ওই ব্যক্তির অন্য কোনো লক্ষণ আছে কিনা যা ইঙ্গিত করবে যে, তিনি নির্দিষ্ট কোনো মানসিক ডিসঅর্ডার বা রোগে ভুগছেন কিনা তাও পরীক্ষা করতে হবে।


অথবা এই লক্ষণগুলো আইসোলেটেড বা বিচ্ছিন্ন কিনা।


একজন ব্যক্তি বিষন্নতা বা অন্য কোনো রোগে নাও ভুগতে পারেন অথবা তারা মাদক ব্যবহার নাও করতে পারে। কিন্তু তারা রাগের বিস্ফোরণের অনুভূতির মুখোমুখি হতে পারেন। এই বিস্ফোরক অনুভূতিগুলো ছাড়া, তাদের জীবন স্বাভাবিক, ব্যাখ্যা করেন আজার। 


শেয়ার করুন