আগামী বছরের শুরুতেই লেনদেন শুরু হচ্ছে বহুপ্রতীক্ষিত কমোডিটি এক্সচেঞ্জের। চলতি সপ্তাহের মধ্যে এসংক্রান্ত আইনের গেজেট প্রকাশিত হবে। এ ছাড়া খুব শিগগির লাইসেন্স হস্তান্তর করা হবে বলে ঢাকায় সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদলের সদস্যদের জানিয়েছেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। বৈঠক সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
বৈঠক সূত্র জানায়, বিএসইসির কার্যালয়ে গতকাল আইএমফের সঙ্গে কমোডিটি এক্সচেঞ্জসহ চারটি ইস্যু নিয়ে আলোচনা করা হয়। এগুলো হচ্ছে পুঁজিবাজারের বর্তমান, নতুন আইনকানুন, গ্রিন বন্ড ও সর্বজনীন পেনশন স্কিম।
জানতে চাইলে বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এক বছর আগে এই প্রতিনিধিদল আমাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিল, সেই বৈঠকের পর থেকে আমাদের কী উন্নতি হয়েছে তা তারা জানতে চেয়েছে। গত এক বছরে পুঁজিবাজার উন্নয়নে আমরা কী কী করলাম, সেই বিষয়ে আইএমএফের প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছি।
সেখানে আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল কমোডিটি এক্সচেঞ্জ। আগামী বছর কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু হবে বলে আইএমএফ প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছি। দু-এক দিনের মধ্যে এসংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হবে। আমরা লাইসেন্স হস্তান্তর করব এ বছরেই।
এরপর সফটওয়্যার কেনাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো পর্যায়ক্রমে হবে।’
বিএসইসি চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘কিছু বিষয়ে তাদের সহযোগিতা চেয়েছি। বিশেষ করে একটি বড় ফান্ড সাপোর্টও চাওয়া হয়েছে। বলেছি, এই সহযোগিতা পেলে আমাদের আগামী দিনের কাজগুলো করতে অনেক সহজ হবে।’
বৈঠক সূত্র জানায়, কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু করতে আইএমএফের সহযোগিতা চেয়েছে বিএসইসি।
সিএসইকে অটোমেশন করতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিএসইসি নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কমোডিটি এক্সচেঞ্জ খুব দ্রুত চালু করা হচ্ছে না কেন জানতে চেয়েছে প্রতিনিধিদল। আমরা বলেছি, এটি দ্রুত চালু করতে কাজ করছি। এরই মধ্যে বিএসইসির একটি প্রতিনিধিদল ভারতে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ ও কমোডিটি ডেরিভেটিভ মার্কেট দেখে এসেছে। বাজারে নতুন পণ্য আনতে বিএসইসি কাজ করছে।’
কমোডিটি এক্সচেঞ্জ কী
কমোডিটি এক্সচেঞ্জ পণ্য কেনাবেচার ডিজিটাল প্ল্যাটফরম, যেখানে বিভিন্ন পণ্য কাগুজে বা ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে কেনাবেচা হয়ে থাকে। মূল পণ্যটি কোনো গুদামে বা মাঠে থাকে। সেখান থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর এটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু হলে দেশি-বিদেশি সব ক্রেতা-বিক্রেতা ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে পণ্য কেনাবেচার সুযোগ পাবেন। এতে পণ্য কেনাবেচায় স্বচ্ছতার পাশাপাশি ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু হলে পণ্যের উৎপাদক ও ভোক্তা সঠিক দামে পণ্য কেনাবেচা করতে পারবেন। অর্থনীতিতে নতুন গতি আসবে। বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমে আসবে।
সূত্র জানায়, গম, তুলা ও সোনা কেনাবেচার সুযোগ রেখে দেশে প্রথম পণ্য বিপণনের এই মাধ্যম চালু করতে কাজ করছে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)।
বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের আর্থিক বাজারের জন্য কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্ল্যাটফরমের ধারণাটি নতুন এবং বাংলাদেশের মতো বৃহৎ বাজার বিবেচনায় এ দেশে কমোডিটি এক্সচেঞ্জের সম্ভাবনা অনেক। কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে উন্নয়নের এক নতুন মাত্রা যোগ হবে।
কমোডিটি এক্সচেঞ্জের পণ্য কী
কমোডিটি এক্সচেঞ্জের পণ্যগুলো কৃষি পণ্য ও অকৃষি পণ্য—দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। কৃষি পণ্যের মধ্যে রয়েছে নিত্যপণ্য, যেমন—চাল, ডাল, গম, পেঁয়াজ, আলু, ভোজ্য তেল, ফল, চা ইত্যাদি। অকৃষি পণ্যের মধ্যে রয়েছে জ্বালানি তেল, গ্যাস, স্বর্ণ, লোহা, কয়লা ইত্যাদি। বিশ্বব্যাপী কমোডিটি এক্সচেঞ্জে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ১০টি পণ্য হলো অপরিশোধিত জ্বালানি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, স্বর্ণ, রুপা, কপার, গম, তুলা, ভুট্টা, চিনি ও কফি।
ভারতীয় কম্পানিকে পরামর্শক নিযুক্ত
কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু করতে ভারতের মাল্টি কমোডিটি এক্সচেঞ্জের (এমসিএক্স) সঙ্গে জোট করেছে সিএসই। এক্সচেঞ্জ চালুর জন্য ভারতের মুম্বাইভিত্তিক কমোডিটি এক্সচেঞ্জ এমসিএক্সকে মূলত পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে কমোডিটি এক্সচেঞ্জটি শতভাগ সিএসইর মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় চলবে, যেখানে এমসিএক্স পরামর্শক হিসেবে শুধু পাঁচ বছরের জন্য কাজ করবে।
আইনে কী আছে
কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর জন্য আইন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আইনটি চূড়ান্ত হওয়ার পর আগ্রহীরা কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে আবেদন করবেন। পাশাপাশি কমোডিটি এক্সচেঞ্জে লেনদেনে অংশগ্রহণের জন্য আগ্রহী ব্রোকারেজ হাউসগুলোকে আলাদাভাবে অনুমোদন নিতে হবে। এর পরই অনুমোদিত এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে পণ্য লেনদেন চালুর উদ্যোগ নেওয়া হবে।
খসড়া আইনে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠায় যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, তার বেশির ভাগই দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জের ক্ষেত্রেও রয়েছে। তবে প্রথমবারের মতো কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর উদ্যোগের সঙ্গে এখন পর্যন্ত জড়িত রয়েছে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ বা সিএসই। তারা তাদের এসংক্রান্ত প্রস্তুতি অনেকটাই গুছিয়ে এনেছে বলে স্টক এক্সচেঞ্জটির শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ব্রোকারেজ হাউস হিসেবে যুক্ত হতে পারবে কারা
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, লেনদেনের জন্য অনুমোদিত ‘ট্রেক হোল্ডার’ বা ব্রোকারেজ হাউস ছাড়া অন্য কেউ কমোডিটি এক্সচেঞ্জে লেনদেন করতে পারবে না। ব্রোকার হিসেবে নিবন্ধনের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউসের ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন হতে হবে ১০ কোটি টাকা। ব্রোকারেজ হাউসের পরিচালনা পর্ষদের কোনো সদস্য যদি অপরাধ, প্রতারণা ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকেন বা ঋণখেলাপি হন, তবে ওই ব্রোকারেজ হাউস নিবন্ধনের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।